ষাটের দশক ঐতিহাসিক হিসাবে আমার প্রিয় দশক। ষাটের দশক হলো প্রতিবাদের দশক, নতুন চিন্তার দশক ছায়াছবির জগতে আলোড়নের দশক এবং কবিতায় নাটকে পরীক্ষা নিরীক্ষার দশক। বাংলায় খাদ্য আন্দোলন, যুক্তফ্রন্টের উত্থান , প্রতিবেশী চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব , প্রতিবেশী পাকিস্তানে (পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয়েই ) গণ অভ্যুত্থান , প্যারিস, মক্সিকো নগরী, বার্লিন , দার এস সালাম , প্রিটোরিয়ার রাজপথে প্ৰতিবাদের উল্লাস, আলজেরিয়ার স্বাধীনতা লাভ এবং কিউবার বিপ্লবের কমিউনিস্ট রাজীনীতির দিকে চালনার দশক। বীরভূমের প্রত্যন্ত প্রান্তরে আমার পাড়ায় প্রবীর সাহা , সুহিতা সাহা , দীপঙ্কর রায় দের বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনে যোগদানের দশক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন ,নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং ড. কিংয়ের হত্যা, ভিয়েতনামে স্টেট অফেন্সিভ, ল্যাটিন আমেরিকায় বিপ্লবী চের হত্যা। রেজিস দেবরের চিলিতে বিপ্লবের অভ্যন্তরে বিপ্লবের ঘোষণা, মৌলানা ভাসানীর হুঙ্কার, কিউবার তিন মহাদেশের বিপ্লবীদের সমাবেশে, ফয়েজ আহমদ ফায়েজের কবিতার বিপ্লবী প্রতিধ্বনি ষাটের দশকের ছবি। এই দশকে জন্ম হয় নতুন বামপন্থার। সব মিলিয়ে ষাটের দশক আমার অজপাড়া থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের এক অদ্ভুত বিপ্লবী উন্মাদনাতে পরিপূর্ণ। নিশ্চয়ই ষাটের দশকে জীবন চলেছে নিজস্ব ছন্দে। মানুষের জন্ম হয়েছে, মৃত্যু হয়েছে, প্রেমের শিহরণ জেগেছে, বিবাহ হয়েছে , বিবাহের বিচ্ছেদ হয়েছে কিন্তু তবুও সেই দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে থেকেছে নতুনের উন্মাদনা আর মিছিলের মুষ্টিবদ্ধ হাত। আমার রোমান্টিক কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে পারেন এই ষাটের দশকের ছবি। কিন্তু রোমান্টিকতার তো এক বাস্তব উপাদান থাকে।
ছায়াছবির জগতে পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে আমাদের দেশেও নতুনত্বের ঘোষণা। ঢাকায় জাহির রায়হানের বাংলা ছায়াছবিতে নবনির্মাণ: বেহুলা, কখনো আসেনি , জীবন থেকে নেয়া; কলকাতায় ঋত্বিকের দেশ বিভাগের উপর তিনটি ধারবাহিক ছবি: মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা এবং কোমল গান্ধার; যার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে জাতপাত, পুঁজির কাছে দাসত্বের পরাজয়, এ যুগের সীতার মর্মস্পর্শী আর্তনাদ , আর নতুন উদ্বাস্তু পরিবারের নারীর শ্রমকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার প্রয়াস , জীবনধর্মী নাটকের দলের মধ্যে দেশ বিভাগের ছায়া। সেই এই দশকে নির্মিত সত্যজিতের মহানগরে মহিলাদের চাকরি করা নিয়ে পরিবারের মধ্যে রাজনীতি, বাঙালি এবং এংলো ইন্ডিয়ান মহিলার মধ্যে বন্ধুত্ব এক নারীবাদী সংহতির হাতছানি দেয়। তুলনায় মৃণাল সেনের ১৯৬৯ সালের ছবি ভুবনসোম এক অদ্ভুত স্নিগ্ধ মায়াময় ছবি। যেন ষাটের দশকের বিপ্লবী দাবানলের থেকে অনেক দূরে গুজরাটের গৃহস্থালিতে বয়স্ক ভুবন সোমের রূপান্তরই এই দশকের ছায়াছবি আর উপহার। কিন্তু নাটকের মঞ্চে কলকাতায় তখন কল্লোল (১৯৬৪ ), মানুষের অধিকার (১৯৬৫ ), লৌহ মানব (১৯৬৯ )-- এক আগুনের স্পর্শ। ঢাকাতে সেই সময় সৃজনী শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিবাদী নৃত্যনাট্য নিয়ে নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। সেই সময়ে তাদের নিবেদন ছিল ভোরের পথযাত্রী, জ্বলবে আগুন ক্ষেতে খামারে। কলকাতা এবং ঢাকা থেকে বহুদূরে পুঁজিবাদের উন্নতির শিখরে অবস্থিত প্যারিসেও তখন এক নতুনত্বের ছোঁয়া।
ফরাসি নতুন ধারার ছবি সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটি ছায়াছবির জগতে রূপান্তরের অঙ্গীকার। ১৯৫৪ সালে François Truffaut, Bazin-এর স্থাপিত Cahiers du cinéma পত্রিকায় নয়া ধারার ইস্তেহার লেখেন Une certaine tendance du cinéma français। Jean-Luc Godard-এর উত্থান এবং তাঁর গৎ ভাঙা ছবির দিকপরিক্রমা ষাটের দশকে। ১৯৪৯ সালে ফ্রান্সে বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হবার পরে Godard আশ্রয় নেন সিনে ক্লাবে। সেখানেই তাঁর পরিচয় হয় ছায়াছবির সমালোচক André Bazin-এর সঙ্গে; আলাপ জমে ওঠে ভবিষ্যৎ পরিচালক François Truffaut, Claude Chabrol এবং Jacques Rivette-এর সঙ্গে। Godard হলিউডের ছায়াছবি নির্মাণের ধারাকে সমর্থন করেন। হলিউডের Howard Hawks যিনি আখ্যানভিত্তিক নানা ছবি তৈরি করেন, যেমন A Girl in Every Port (1928), The Dawn Patrol, (1930), Scarface (1932), (Gentlemen Prefer Blondes, (1953), The Thing (1951), বা westerns ছবি Red River, (1948 ); Rio Bravo, (1959)। Godard এ ধারার ছবির নির্মাণের ভক্ত ছিলেন। Howard Hawks গল্পের উপর জোর দিতেন এবং নিটোল গল্প বলতেন। তিনি ছবি নির্মাণ করতেন ছবির প্রযুক্তির উপর জোর দিয়ে। Otto Perminger ছবি করতেন কালো রহয়সময় ধারার ছায়াছবি । তাঁর বিখ্যাত ছবি হলো Laura (1944) এবং Fallen Angel (1945)। আবার Godard ছিলেন অভিনেতা Humphrey Bogart-এর ভক্ত। আমার কাছে মনে হয় যাঁরা Humphrey Bogart অভিনীত High Sierra (1941) বা The Maltese Falcon (1941)অথবা Casablanca (1942) দেখেন নি, তারা মার্কিন ছায়াছবির শাস্ত্রীয় ঘরানার ছবি দেখেন নি।
Humphrey Bogart প্রতিবাদী অভিনেতা ছিলেন। তিনি তৈরি করেন Committee for the First Amendment এবং প্রতিবাদ করেন House Un-American Activities Committee's-এর হলিউডের অভিনেতাদের উপর মিথ্যা দোষারোপের বিরুদ্ধে। সেই সময়ে হলিউডে দশ নাম, দশজন লেখক, অভিনেতা, যেমন Alvah Bessie, Herbert Biberman, Lester Cole, Edward Dmytryk, Ring Lardner, Jr., John Howard Lawson, Albert Maltz, Samuel Ornitz, Adrian Scott, and Dalton Trumbo-এর বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট অভিযোগে গেরেফতারি পরোয়ানা বের হয়। হামফ্রের অবশ্য পরে ১৯৪৮ সালে একটি প্রবন্ধ লেখেন ,ফোটোপ্লে পত্রিকায় , ১৯৪৮ সালে সংখ্যায়-- "I'm No Communist" ।
Jean-Luc Godard ১৯৬০ সালে বাজারে নিয়ে আসেন তাঁর ছবি Breathless, (দমবন্ধ )। সেই দমবন্ধের নায়ক মিচেল কিন্তু Humphrey Boggart-এর আদলে তৈরি এক গাড়ি চোর। গল্পটা মিচেল আর তার বান্ধবী প্যাট্রিসিয়াকে নিয়ে। গল্পের শেষে প্যাট্রিসিয়া পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে মিচেলকে। রাস্তায় পালাতে গিয়ে মিচেল মারা পড়বে পুলিশের গুলি খেয়ে, দমবন্ধ হয়ে। গল্পটা নিটোল। আমি ছবির ভাষা টেকনিক বুঝি না, আমার মনে হয়েছে গল্পটা এক নৈরাজ্যবাদী ছায়াছবির পরিচালকের তৈরি গল্প। আমার মতো রাজনৈতিক জানোয়ারের কাছে গল্পটা খুবই নৈরাজ্যময়। কিন্তু আমার প্রিয় Godard-এর ছবি হলো যা ফরাসি সরকার ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত প্রেক্ষাগৃহে মুক্ত হতে দেন নি। ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ষাটের দশকের গোড়ায় পৃথিবীর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল আলজেরিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ । সমস্ত বামপন্থী জগতের উপরে তার ছায়া পড়েছিল। প্রখ্যাত জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের তাত্ত্বিক ও মনস্তত্ত্ববিদ ফানোঁ, আলজেরিয়াতেই তাঁর বিপ্লবী রূপান্তর ঘটে। পূর্ববাংলার ছায়াছবি সমালোচক (পরবর্তী সময়ে নির্মাতা) আলমগীর কবির লন্ডনে আলজেরিয়ার সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দেবার পরিকল্পনা করেন এবং লন্ডনে তিনি পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্যে সংবাদপত্র পরিচালনা করেন। অর্থাৎ আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম বাংলার রাজনৈতিক জীবনে তার ছায়া ফেলে। কিন্তু ফরাসি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রামে কোনো সাহায্য করে নি। সেই পরিস্থিতিতে Godard তাঁর ছবিতে দেখান ছবির নায়ক ব্রুনো জেনেভাতে পালিয়ে আছে, আলজেরিয়াতে যাবে না বলে, কিন্তু তার সঙ্গে যোগ রয়েছে কুখ্যাত লাল হাত বলে পরিচিত ফরাসি বিদেশী বিভাগের সন্ত্রাসবাদী গুপ্তচর সংস্থার। তারা তাকে খুন করতে বলে FLN ( Front de libération nationale), আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনের Palivoda বলে একজনকে । ব্রুনো এরই মধ্যে প্রেমে পরে যান Véronica Dreyer বলে এক মহিলার। ব্রুনো Palivoda কে হত্যা করতে রাজি হন এই শর্তে যে তাকে এবং Véronica কে ব্রাজিলে চলে যেতে দেবে ফরাসি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এর মধ্যে ফরাসি কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে Véronica FLN-এর সঙ্গে যুক্ত। ফরাসিরা Véronica-কে চূড়ান্ত যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করে। আমি ছায়াছবিটা দেখেছিলাম অনেক পরে, ১৯৯০ সালে। ছবিটা জরুরি অবস্থার সময়ে পশ্চিমবাংলায় পুলিশের অত্যাচারের কথা মনে পড়িয়ে দেয়, আর সেই সঙ্গে মনে পড়ে আর বিভিন্ন লেখার মধ্যে পূর্ববঙ্গে ইলা মিত্রর উপর পাকিস্তান পুলিশের অত্যাচার, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অগণিত নারীর উপরে অত্যাচারের কথা। সেই থেকে আমার মনে Jean-Luc Godard হয়ে যান ষাটের দশকের বিশ্বজোড়া সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক উত্থানের সঙ্গে যুক্ত এক ব্যক্তিত্ব।
আমি বিধান রিবেরু , অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বা অধ্যাপক ছন্দক দার ( সেনগুপ্ত ) বা আমার সুহৃদ মামুনুর রশিদের মতো চলচ্চিত্র বোদ্ধা নই। আমার কোনো নেশা নেই, শুধু ছায়াছবি , হালকা বামপন্থি রাজনীতি আর দুই বাংলা প্রীতির হালকা নেশা ছাড়া। আমার গুরুজন বিক্রমণ নায়ারদা তাঁর ভ্রমণ কাহিনি পশ্চিম ইউরোপের দিনলিপিতে লিখেছিলেন, শুভর সবই ভালো, শুধু ওর বামপন্থার প্রতি দুর্বলতা ছাড়া। সেটি আবার আনন্দবাজারে ধারাবাহিকভাবে বের হয়েছিল। ফলে আমার রাজনীতি লুকিয়ে রাখার কোনো অবকাশ নেই। বহু আগে আমার দুই বন্ধু অংশুমান মিশ্র আর সমুন্ত্র চক্রবর্ত্তী (রাজা ) আর পরে অসীম চট্টরাজের সঙ্গে সিনেমার নেশা। আর সেই সঙ্গে রাজনীতির হালকা নেশায় হাতে খড়ি হয়েছিল উত্তরশিক্ষা সদনে একাদশ শ্রেণিতে রাজার সঙ্গে ঋত্বিকের ছায়াছবির প্রদর্শনীতে গিয়ে। সেই সময়েই শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের প্রতি আকর্ষণ। তারই এক টুকরো ছবি Godard-এর জীবনাবসান উপলক্ষ্যে পেশ করলাম। সেই সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে রাখি আর কয়েক মাসের মধ্যে আমার একটি বই প্রকাশিত হবে Intimation of Revolution: Global Sixties and the Making of Bangladesh কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে। আপনারা যদি পড়েন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকবো।