সেকেন্ডে চব্বিশ ফ্রেমের প্রেমে পড়া লোকের সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। এই প্রেমিকদের অধিকাংশই দর্শক। তাদের দিকে তাকিয়েই চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রযোজক পয়সা ঢালেন, তাদের উপর চলচ্চিত্রের জাদুপ্রভাব দেখেই ছক পরিকল্পনা করে রাষ্ট্র। এখানে ভ্লাদিমির লেনিনকে স্মরণ করতেই হয়। রাষ্ট্রনায়কদের ভেতর তিনিই প্রথম চলচ্চিত্রের শক্তিকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। মস্কোতে তৈরি করেছিলেন দুনিয়ার প্রথম চলচ্চিত্র বিদ্যালয়। পয়লা বিশ্বযুদ্ধ শেষে ও বিপ্লবী সরকারের যাত্রা শুরুর পরপরই লেনিন বলেছিলেন, অন্য শিল্পের চেয়ে চলচ্চিত্রই হলো তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। যে সময় চলচ্চিত্রকে নেহায়েত স্বস্তা বিনোদন হিসেবেই বিবেচনা করা হতো, তখন লেনিন একে বলছেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এই বোধদয় হওয়ার পেছনে যে মানসিক গড়ন প্রয়োজন, তা আমাদের দেশে বিরল। নয় তো স্বাধীনতা অর্জনের পঞ্চাশ বছর হয়ে গেলেও জাতীয় বা ব্যক্তি পর্যায়ে একটিও চলচ্চিত্র কেন্দ্র নেই। আর ফিল্ম ও টেলিভিশন ইন্সটিটিউট হলো মাত্র বছর কয়েক আগে (২০১৪ সালে)।
চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরেকটি সংস্থা রয়েছে: বিএফডিসি। পাকিস্তান আমলে নির্মিত সেই সংস্থায় বর্তমানে চলচ্চিত্র বা এর উন্নয়ন সাধনে দৃশ্যমান কিছু চোখে পড়ে না, পত্রপত্রিকায় যা আসে তা হলো, বিভিন্ন সংগঠনে নিজেদের ভেতর রেষারেষি ও কোন্দলের খবর। অন্যদিকে দেখি, এফডিসির পরিচালক সমিতি মন্ত্রী এনে, লোক দাওয়াত করে চলচ্চিত্রের জন্য নতুন মুখ সন্ধানে প্রতিযোগিতার ঘোষণা দিয়েও, আজোব্দি শুরু করতে পারেনি, সেটি ২০১৮ সালের ঘটনা। এই সমিতি আবার এফডিসির পাঠাগার দখল করে রেখেছে, সেখানে না আছে বই, না আছে পাঠক। এফডিসি ও এর ভেতরে থাকা ‘চলচ্চিত্র পরিবারে’র অভ্যন্তরীণ নানা জটিলতার চালচিত্র দেখলেই জাতীয় পর্যায়ে চলচ্চিত্রের দুরাবস্থার কারণ অনুমান করা যায়। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণ ও সঠিক জায়গায় যোগ্য লোক নিয়োগের সংকট তো আছেই।
এর সাথে আরেকটু যোগ করতে চাই, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রসঙ্গ। কে না জানে, চলচ্চিত্র একটি যৌথ শিল্প। এই শিল্পে প্রায় শুরু থেকেই বড় ভূমিকা পালন করে আসছে চলচ্চিত্র সাহিত্য, অর্থাৎ চলচ্চিত্র কেন্দ্রিক লেখালেখি ও বইপত্র। তো চলচ্চিত্র সাহিত্যের উপর ভর করেই বিভিন্ন ইন্সটিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে চলচ্চিত্র অধ্যয়নের কাজ করে থাকে। এ থেকে চলচ্চিত্র কারখানাও উপকৃত হয়। কিন্তু দেখুন চলচ্চিত্র সাহিত্যও এদেশে উপেক্ষিত। ভারতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে দুটি পুরস্কার দেয়া হয় এই সাহিত্যকে ভিত্তি করে: একটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিষয়ক বই ও আরেকটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র সমালোচক। এই স্বীকৃতির প্রয়োজন রয়েছে। কেন প্রয়োজন তার বিষদ করবো না, শুধু বলবো, যে কারণে দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রে পুরস্কারের চল আছে, সে কারণেই এখানে তা দরকার। বিনোদন সাংবাদিকরাও এদেশে স্বীকৃতি পান। অন্যদিকে, চলচ্চিত্র লেখকরা সাহিত্যের ঘরানাতেও ঢুকতে পারেন না, আবার চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট আয়োজনেও তারা থেকে যান ব্রাত্য। অথচ চলচ্চিত্র বিষয়ক অধ্যয়ন ও গবেষণায় তাদের লেখা পড়ানো হচ্ছে ও কাজে লাগছে, তারচেয়েও বড় কথা চলচ্চিত্র সম্পর্কিত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় তারা অবদান রাখছেন। কিন্তু ভেবে দেখুন, স্বীকৃতির বেলায় তারা কোথাও নেই।
রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে যদি ব্যক্তি মালিকানার দিকে একটু তাকাই, দেখবো সেখানেও ভালোবাসার বড় অভাব। ১৯৭০ সালে তেজগাঁও পূর্ব তেজতুরী বাজারে এম.এ বারী নির্মাণ করেন বারী স্টুডিও, সত্তর থেকে আশি, এই দুই দশকে নির্মিত বহু বিখ্যাত ছবিতে স্টুডিওটির নাম দেখা যায়, কিন্তু সম্প্রতি একে ভেঙে মসজিদ করা হয়েছে। বারী স্টুডিও বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, কারণ এটি ঢাকায় স্থাপিত ব্যক্তি মালিকানায় দ্বিতীয় চলচ্চিত্র স্টুডিও। প্রথমটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে টিকাটুলি এলাকায় কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে, নাম: বেঙ্গল মোশন পিকচার্স স্টুডিও। এর প্রতিষ্ঠাতা অনেকে হলেও, ১৯৭২ সালে বজলুর রশীদ এককভাবে এর মালিকানা গ্রহণ করেন। তবে এটি বন্ধ হয়ে যায় নব্বইয়ের দশকে।
রোজ গার্ডেনের ইতিহাস চমকপ্রদ। ইংরেজ আমলে ঋষিকেশ দাস নামের এক নব্য ধনীর গোলাপ বাগানের বিলাসিতা থেকে বেহিসাবি জীবনযাপন, এরপর হাতবদল, কালবদল, তারপর বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাথে জড়িয়ে যাওয়া। বাইশ কি তেইশ বিঘা জমির উপর নির্মিত এই রোজ গার্ডেন থেকে বেঙ্গল মোশন পিকচার্স স্টুডিও হওয়া এবং এরপর মূল মালিকের দখল ফিরে পাওয়া ও সরকারের সেটিকে কিনে নেয়া ইত্যাদি নানা ইতিহাস রয়েছে। তবে যা দেখে কষ্ট লাগে, তা হলো এত বিশাল জায়গাটিকে চলচ্চিত্রের জন্য ব্যবহার করা যেত চমৎকারভাবে, বিশেষ করে এখানেই যদি ফিল্ম ইন্সটিটিউট গঠন করা যেত, কিন্তু তা হয়নি!
মহারাষ্ট্রের পুনেতে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল প্রভাত চলচ্চিত্র স্টুডিও প্রাঙ্গনে। স্টুডিওর বিশাল সেই এলাকা এখন গোটা ভারতবর্ষের শিক্ষার্থী ও পণ্ডিতদের জন্য প্রধান চলচ্চিত্র শিক্ষা ও চর্যাকেন্দ্র। আমাদের টিকাটুলির প্রথম স্টুডিওটিও কিন্তু সেরকম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারতো। খোলামেলা জায়গা ছিলো, এতে শিক্ষার্থীরা উন্মুক্ত পরিবেশে জ্ঞানার্জন করতে পারতো। কিন্তু সেই দূরদর্শন কোথায়?
আমাদের দ্বিতীয় কারখানা বারী স্টুডিওকে ভাঙা হলো বছর কয়েক আগে। চলচ্চিত্রকে ভালোবাসলে এটিকে চলচ্চিত্র জাদুঘরেও রূপান্তর করা যেতো। ভারতের মুম্বাইতে জাতীয় চলচ্চিত্র জাদুঘর রয়েছে। ইউরোপে তো আছেই। আমাদের সরকারী কর্মকর্তারা কতকিছু দেখতে দেশের বাইরে যান, অঢেল পয়সা খরচ করেন, অথচ এগুলো তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। বারী স্টুডিওকে সরকারের তরফ থেকেও জাদুঘর করা যেতো। সেই দায় সরকার যেমন বোধ করেনি, তেমনি বারীর পরিবারও না। আমরা ইতিহাস ধরে রাখতে জানি না। ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ তো বহুদূরের ব্যাপার। অথচ এই বারী স্টুডিওতেই জাদুঘর বানিয়ে, দশকওয়ারী ক্যামেরা, লাইট ও সম্পাদনার যন্ত্র সংরক্ষণ করা যেতো, তাদের স্টুডিও থেকে হওয়া চলচ্চিত্রগুলোর রিল, মূল পোস্টার এবং ওসব ছবি নিয়ে একটি ইতিহাস ভিত্তিক বইও লেখা যেতো। এসবের কিছুই হয়নি।
এদেশে চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা আসলে একপাক্ষিক, সেই পক্ষের নাম দর্শক। অপর পক্ষে দর্শকের আবেগ ও অনুভূতিকে পুঁজি করে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতিযোগিতা দেখি। বাংলাদেশে খুব কম মানুষ চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে চলচ্চিত্র নির্মাণে এসেছেন। অবশ্যই চলচ্চিত্র একটি খরুচে ব্যাপার এবং এ সংক্রান্ত শিক্ষালয় ও চর্চাকেন্দ্রও কম অর্থের ব্যাপার নয়। সেক্ষেত্রে আসলে এগিয়ে আসতে হয় সরকারকে। ব্যক্তির পক্ষে উদ্যোগ আর সরকারের পক্ষে সহযোগিতা, তাহলেই এধরনের কার্যক্রম এগিয়ে যায়।
অনেক বলে কয়ে একটি ইন্সটিটিউট হয়েছে, একটি আর্কাইভও আছে আমাদের, এখন দরকার একটি চলচ্চিত্র কেন্দ্রের। এই কেন্দ্র চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রশিক্ষণ দেবে না, কিন্তু চলচ্চিত্রকে বোঝার জন্য মনের দরজা খুলে দেবে। এখানে সাধারণ দর্শক যেমন যুক্ত হবেন, তেমনি জড়িত হবেন চলচ্চিত্র লেখক, পণ্ডিত, সাংবাদিক এবং অবশ্যই চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক ও কলাকুশলীরা। তারা চলচ্চিত্র বিষয়ক চিন্তাকে শাণিত করবেন এখানে। এই কেন্দ্রের কাজ হবে দৈনিক দুপুরের পর থেকে দুটি করে চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা, নিয়ম করে রেট্রোস্পেকটিভ করা ও তদসংক্রান্ত আলোচনার আয়োজন করা, সাপ্তাহিক সিনেমার বুলেটিন বের করা, মাসিক ফিল্ম অ্যাপ্রেসিয়েশন কোর্স চালু রাখা, ষান্মাসিক আন্তর্জাতিক সেমিনার করা, বাৎসরিক একটি উন্নতমানের জার্নাল প্রকাশ করা এবং একটি চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন করা। এটি একটি কেন্দ্রের পক্ষেই সম্ভব। এমন পরিবেশ থাকলে তরুণরাও চিন্তাশীল হতে শিখবে, শুধু চলচ্চিত্রের দুনিয়ায় নয়, অন্য ক্ষেত্রেও অবদান রাখতে পারবে।
বাংলাদেশে জাতীয় চলচ্চিত্র বা মূলধারার চলচ্চিত্র বলি, সেখানে যেমন বন্ধাকাল চলছে, তেমনি স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও নিয়মিত কোন ছবির দেখা মিলছে না। আমাদের জাতীয় পর্যায়ে ইন্সটিটিউট ও আর্কাইভ আছে বটে, কিন্তু দেশের চলচ্চিত্রের চালচিত্র পাল্টে দিতে এখনো পর্যন্ত তারা বলার মতো কোন অবদান রাখতে পারছে না। চলচ্চিত্র কেন্দ্র গড়ে তোলার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। এমন অবস্থায় আমাদের প্রেক্ষাগৃহ কমতে কমতে এসে ঠেকেছে আড়াইশতে। আর এই মহামারীকালে সচল সিনেমা হলের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র বাষট্টিতে। মাল্টিস্ক্রিনের সিনেপ্লেক্সগুলোও ধুকছে। ওটিটি প্লাটফর্মগুলোতেও ভালো কন্টেন্ট দিয়ে তেমন সাড়া জাগাতে পারছে না কেউ। বলা বাহুল্য নয়, কারিগরি ও শিল্পবোধ সম্পন্ন নির্মাতা হয় তো আমাদের আছে, কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র বলি, আর ওটিটি প্লাটফর্মের সিরিজ, দুই জায়গাতেই আমাদের ভালো চিত্রনাট্যকারের অভাব রয়েছে। সেই অভাব পূরণ হতো যদি আমাদের তরুণদের বিপুল অংশ শুধু বিসিএস পরীক্ষা, বিবিএ, এমবিএ এসবের পেছনে না দৌঁড়ে একটু সাহিত্যকেও ভালোবাসতো। খোঁজ নিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থাকা সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক ইত্যাদি এমন বিভাগে পড়তে কতজন স্বেচ্ছায় আসে, আর কতজন অন্য কোথাও সুযোগ না পেয়ে আসে। অথচ এই বিষয়গুলোকে ভালো না বাসলে, এগুলোকে নিয়ে সংসার না করলে, কিছুই করা সম্ভব নয়। তাহলে ভালোবাসা গেলো কোথায়? এর দায় কি দেশের সরকার ও এলিট শ্রেণী নেবে না? এমন সমাজ কেন, কখন, কার স্বার্থে গঠিত হলো, যেখানে শুধু অর্থ সংক্রান্ত পড়ালেখা কদর পায়? আর্থিক উন্নয়নের দিকটাই গুরুত্ব পায়? একারণেই কি সমাজে বিকৃতি দেখা যাচ্ছে না? জাতির পকেট ভারি করতে যতটুকু আমরা মনোযোগী, ঠিক ততোটাই অমনোযোগী জাতির মনমানসিকতার উন্নয়নে। দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় আমাদের কীর্তি দেখলেই সেটা সহজে অনুমান করা যায়।
বিধান রিবেরু: সম্পাদক, সিনেমা দর্শন (রচনাকাল: ২০২০)