সিনেমারণ্য

নিরবে শতবর্ষ পেরুচ্ছেন বেপরোয়া পাসোলিনি

বিধান রিবেরু প্রকাশিত: মার্চ ১১, ২০২২, ১২:২৬ পিএম নিরবে শতবর্ষ পেরুচ্ছেন বেপরোয়া পাসোলিনি

গির্জায় কম্যুনিয়ন গ্রহণ ও খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা নেয়ার কিছুক্ষণের ভেতর এক বালক, নাম রিকেতো, চুরির খাতায় নাম লেখায়। এরপর ধীরে ধীরে সে মারামারি, ডাকাতি, বেশ্যালয় গমন কোনো কিছুই বাদ দেয় না। তার সঙ্গীসাথীও কিছু খুন হয়ে যায়। অর্থাৎ ধর্ম সবসময় মানুষকে সৎ ও মানবিক পথে চালিত করতে পারে না। মানুষের লোভ, হিংসা ও রিরংসা এসব দমন করতে পারে একমাত্র মানুষেরই শুভ বুদ্ধি।

রিকেতোকে পাওয়া যায় ‘রাগাৎসি দি ভিতা’ (জীবনের পোলাপান, ১৯৫৫) নামের এক উপন্যাসে। এর লেখক শুধু ইতালিতে নয়, মনে হয় গোটা দুনিয়াতেই বেশ সমালোচিত। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালকও বটে, তাঁর নাম পিয়ের পাওলো পাসোলিনি। এ বছর (২০২২) তাঁর জন্মের শতবর্ষ পেরুচ্ছে।

পিয়ের পাওলো পাসোলিনি (১৯২২ - ১৯৭৫)

দুনিয়ায় যখন পয়লা নম্বর বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, তার কয়েক বছর পর, ১৯২২ সালের ৫ মার্চ ইতালির বোলোগনায় জন্ম নেন পিয়ের পাওলো পাসোলিনি। সেসময় বোলোগনা ছিল রাজনৈতিক ঐতিহ্যের দিক থেকে বামঘেঁষা। পাসোলিনির বাবা ছিলেন সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা আর মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পিতার প্রতি খুব একটা ভালোবাসা অনুভব করতেন না পাসোলিনি। যত বড় হয়েছেন, ততোই দূরে সরেছেন। পিতার নীতি তথা স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনীতির প্রতি বিদ্বেষ, পরবর্তী জীবনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে তাঁর সৃষ্টিকর্মের উপর।

তরুণ জীবনে কবিতার দ্বারা আকৃষ্ট হন, কিছুদিন পর মার্কসবাদ। কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যও হয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ধীরে ধীরে মনোযোগ দেন চিত্রনাট্য রচনায়। ষাটের দশকে আবির্ভূত হন নির্মাতা হিসেবে। পুরো এক দশকে সাতটি ছবি বানিয়ে যে খ্যাতি তিনি অর্জন করেন, সত্তরের দশকে এসে চারটি ছবি বানিয়ে ঠিক ততোটাই ‘কুখ্যাতি’ জোটে তাঁর কপালে।

১৯৭১ সালে ‘ডেকামেরন’, ১৯৭২ সালে ক্যান্টারবেরি টেলস, এবং ১৯৭৪ সালে ‘দ্য ফ্লাওয়ার্স অব থাউসেন্ড ওয়ান নাইটস’; এই তিনটি পরিচিত জীবন ত্রয়ী হিসেবে। এই ত্রয়ীতে তিনি নাৎসিবাদ ও পুঁজিবাদকে অস্বস্তির ভেতর ফেলে দেন। আর ১৯৭৫ সালে মার্কুইস ডি সাদের উপন্যাস অবলম্বনে পাসোলিনির ‘সোডমের ১২০ দিন’ বা ‘সালো’ হয়ে ওঠে আরো বিধ্বংসী। এই ছবিটি পুরো দেখা অসম্ভব প্রায়, এতোটাই তীব্র সেই ছবির ভাষা।

মানুষ যে ভেতরে ভেতরে কি অভাবনীয় হিংস্র, বিকৃত, কর্তৃত্বপরায়ণ ও ক্ষমতালোভী তারই চিত্র পাসোলিনি দেয়ার চেষ্টা করেন ‘সালো’ ছবিটির ভেতর দিয়ে। আগের ছবিগুলোতেও তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠান বিরোধী। প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যায় ও জুলুমের জবাব দেয়ার জন্য এমন দৃশ্যভাষা তিনি চলচ্চিত্রে আমদানি করলেন বা বলা চলে রচনা করলেন, যা ওই প্রতিষ্ঠানের চরিত্রের সাথে বেশ মানানসই। তিনি যেন সমাজের উঁচুতলার ক্ষমতালিপ্সু ধনীদের মুখের সামনে আয়না তুলে ধরলেন।

১৯৪৩-৪৫ সাল, যখন ইতালিতে জার্মানির পুতুল সরকার আসীন, অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ প্রবলভাবে হাজির, তখন দেশটিকে বলা হতো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী সালো’। তো পাসোলিনি ক্ষমতাকে দেখতে চেয়েছেন ধর্ষকামের সাথে মিলিয়ে। ছবিটিতে ব্যাংক মালিক, ডিউক, বিশপ ও বিচারক— এই চার শ্রেণির প্রতিনিধিকে দেখিয়েছেন ক্ষমতা কাঠামোর উপরে, শোষক হিসেবে, স্বৈরাচারী রূপে। তাদের দুর্নীতি, ভোগবাদিতা, কর্তৃত্বপরায়নতা, অনৈতিকতা ও বিকৃত যৌনাচারকে পাসোলিনি এমন নগ্ন ও নিষ্ঠুরভাবে তুলে এনেছেন যাতে তিনি স্বভাবতই শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। এবং ‘সালো’ই হয় তাঁর জীবনের শেষ ছবি। পাসোলিনির মৃত্যুর তিন সপ্তাহ পর মুক্তি পেলেও, ছবিটি কয়েক বছর ইউরোপের বহুদেশেই ছিল নিষিদ্ধের তালিকায়।

পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও ধর্ম— এই তিনের কট্টর সমালোচক ছিলেন পাসোলিনি। তিনি একের পর এক বিস্ফোরক চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যাচ্ছিলেন বেপরোয়াভাবে। তবে তাঁর প্রথাবিরোধী ও মূর্তিভঙ্গকারী চলচ্চিত্র ক্রমশই আত্মঘাতী ও বিপজ্জনক হয়ে উঠছিল, যার শেষ পরিণতি আমরা দেখতে পাই পাসোলিনির শেষ চলচ্চিত্রের শুটিং শেষ হওয়ার পর। মৃত্যুর আগের দিন দেয়া সাক্ষাৎকারেও তিনি বলেছিলেন, “আমরা প্রত্যেকেই বিপদের ভেতর আছি”। উনি বুঝতেন, জানতেন নিজের বিপদ সম্পর্কে। নিজের এক ভাইও নাৎসিদের গুলিতে নিহত হন সেসময়। তবু তিনি দমে যাননি।

‘সালো’র শুটিংয়ের পর কিছু রোল চুরি যায়। সেই রোল-চোরদের সাথে দেখা করতেই যাচ্ছিলেন তিনি ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর। ওইদিনই , মাত্র ৫৩ বছর বয়সে, খুন হতে হয় পাসোলিনিকে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল সাধারণ দুর্ঘটনা, কিন্তু পরে অনুসন্ধান করে জানা যায়, তাঁর গাড়ির নীচেই তাকে কয়েকবার পিষ্ট করে হাড়গোড় ভেঙে, লৌহদণ্ড দিয়ে অণ্ডকোষ থেতলে মারা হয়। এরপর লাশের গায়ে ধরিয়ে দেয়া হয় আগুন। সমাজের যে বিভৎস্যতার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন, শৈল্পিক উপায় বের করে নিয়েছিলেন প্রতিবাদ জানানোর, সেই বিভৎস্যতাই তাঁকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়। মাফিয়া কায়দায় তাঁকে থামিয়ে দেয়া হয় চিরতরে। তবে পাসোলিনি আজ সমাদৃত, খুনিরা আজ ঘৃণিত।

এটাই শিল্পের শক্তি। শিল্প যত তীক্ষ্ণ হয়ে উঠবে ততই শাসক ও সহযোগীরা অস্বস্তিতে পড়বে। এক পর্যায়ে তারা মরিয়া হয়ে উঠবে শিল্পীর কাজ থামিয়ে দিতে। সেটা তারা না করা পর্যন্ত দম ফেলবে না। আর যখনই এই ক্ষমতাবান, মাথামোটা, বিশ্রীরকম ধনী লোকগুলো শিল্পীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যত হয় ও পদক্ষেপ নেয়, ঠিক তখনই তারা আসলে শিল্পী ও শিল্পকর্মটিকে মহৎ করে তোলার পথ প্রশস্ত করে দেয়। এমন অসহিষ্ণুতার দেখা মেলে ফ্যাসিবাদী ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই। এসব রাষ্ট্রে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য পিষে ফেলা হয়, সামান্য কার্টুন আঁকার জন্যও জেলে পুরে নির্যাতন চালানো হয়, এমনকি কার্টুনকে সমর্থন করার জন্যও পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়।

আমাদের আজকের পৃথিবীর জন্যও পাসোলিনির মতো শিল্পী দরকার। যারা তাদের সৃজনী দিয়ে মাথার উপর চেপে বসা শাসক ও ক্ষমতার হালুয়া-রুটি খাওনেওলাদের উপর হাতুড়ি চালাতে পারে, ন্যূনতম প্রবল অস্বস্তি তৈয়ার করতে পারে।