সিনেমারণ্য

দুর্গম গিরি আরোহনেই আনন্দ

বিধান রিবেরু প্রকাশিত: মার্চ ১০, ২০২২, ১১:১৭ এএম দুর্গম গিরি আরোহনেই আনন্দ

কেন আমি লিখি তার সুলুক ভিন্নরূপে পেলাম পর্বতারোহীদের কাছ থেকে। শুধু তাই নয়, জীবনের মানে যে “আজ বেঁচে থাকা”, বর্তমানে নয়, একেবারে এই মূহুর্তে নিঃশ্বাস সচল রাখা, সেই দর্শনও শেখা হলো নতুন করে তাদের কাছ থেকেই। আমি যতটুকু বুঝতে পেরেছি পর্বতকে জয় করা একজন আরোহীর উদ্দেশ্য নয়। প্রস্তুতি, সাহস, শক্তি, ঝুঁকি ও মনোবলকে সঙ্গী করে একজন আরোহী যে চূড়ার দিকে যাত্রা করে, সেই যাত্রাটিই তার কাঙ্ক্ষিত আনন্দ। মিলিয়ে দেখলাম, লিখতে থাকার সময়টাকেই আমার ভালো লাগে। যেভাবে নতুন বিষয়ের সাথে বোঝাপড়া করতে করতে, ভাষা-পর্বতের খাঁজে ভর দিয়ে উঠতে থাকি, সেখানেই আমার উত্তেজনা। লেখা শেষ হওয়ার পর তার প্রশমন ঘটে, তখন পরবর্তী লেখার জন্য ভেতর ভেতর নেশা চাপতে থাকে। দুটি ছবি দেখার পর, পর্বতারোহনের সাথে লেখক জীবনের এই মিল পেয়ে আমি রীতিমতো রোমাঞ্চিত।

আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগে আমাকে নেপাল থাকতে হয়েছিল একমাস। আমার ডরমেটোরি থেকে সকালে জানালা দিয়ে দেখা যেত সফেদ বরফাচ্ছাদিত হিমালয় পর্বতমালা, তার উপর সোনালি রোদ। মাসটি ছিল এপ্রিল মাস। আমি জাদুটোনা করা মানুষের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকতাম। আর ভাবতাম চূড়ায় পৌঁছাতে কেমন লাগে। নেপালে থাকাকালে ছোটখাটো পাহাড় বেয়ে উঠেছি, তাতেই যে আনন্দ পেয়েছি, আর যারা দুনিয়ার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায়, তাদের আনন্দ নিশ্চয় মহাবিশ্বকে ছড়িয়ে যায়। আকাশের কাছাকাছিই তো চলে যান তারা! বছর দশেক আগে আবারো যখন নেপালে যাই, সেসময় ফেউয়া হ্রদের টলটলে জলে ‘মাছের পুচ্ছ’ পর্বতের সাদা-সোনালি ছায়ার দিকেও বাকরুদ্ধ হয়ে বসেছিলাম পুরো এক বেলা। পাহাড় আমায় টানে প্রবলভাবে।

যে দুটো ছবির কথা বললাম, গত দুই মাসে সেগুলো দেখে আমি নতুন করে মানুষের অনর্থক অহমিকা আর জীবনের অর্থ অনুধাবন করছি অভিনব মাত্রায়। প্রথমে দেখি ‘ফোরটিন পিকস: নাথিং ইজ ইম্পোসিবল’ (২০২১) এবং পরে দেখি ‘সামিট অব গডস’ (২০২১)। দুটো ছবি থেকেই আমি যেন নতুন করে অক্সিজেন পাই, উদ্যোম পাই, অনুপ্রেরণা পাই। কারো সাথে দেখা হলে যদি বুঝি মানুষটি হতোদ্যম, তাহলে এই ছবি দুটি দেখার পরামর্শ দিই। মানসিক শক্তি সঞ্চয়ের এত বড় খনি আমি সাম্প্রতিক সময়ে আর আবিষ্কার করিনি।

 

১.

‘ফোরটিন পিকস’ একটি প্রামাণ্যচিত্র, নির্মাণ করেছেন টর্কিল জোনস। এই ছবির নায়ক নির্মল পুরজা, রিয়েল টাইম হিরো, অন্তত আমার কাছে। না, দুনিয়ার ১৪টি ভয়ংকর আট হাজারি পবর্ত চূড়ায় সাত মাসের ভেতর আরোহনের জন্য নয়, তিনি আমার নায়কে পরিণত হয়েছেন তার মনোবল আর ইচ্ছাশক্তির কারণে। পাহাড়ে চড়তে শুধু মনোবল লাগে না, লাগে শরীরচর্চা আর অর্থ। কাজেই তিনটি সংপ্রশ্ন মাথায় নিয়ে একজন আরোহীকে প্রস্তুত হতে হয়।

ফোরটিন পিকস: নাথিং ইজ ইম্পোসিবল

নেপালে জন্ম নেয়া নির্মল ব্রিটিশ আর্মির গুর্খা ব্রিগেডের একজন স্পেশাল বোট স্কোয়াড্রনের সেনাসদস্য ছিলেন। কিন্তু পর্বত এক হাতছানির নাম, তাকে আরোহন করা বড় প্রেম। নেপালে ও যুক্তরাজ্যে নিজের পরিবারকে অর্থনৈতিক ঝুঁকির মুখে ফেলে, বিলেতের একমাত্র বাড়িটি বন্ধক রেখে নির্মল পা বাড়ায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে, আপাতদৃষ্টিতে যা অসম্ভব, সেই ‘অসম্ভবে’র নাম তিনি দেন ‘প্রজেক্ট পসিবল ১৪/৭’।  একটি, দুটি, বা তিনটি নয়, ১৪টি গিরিলঙ্ঘনের কাজ সম্পন্ন করার জন্য নির্মল বেছে নেন ২০১৯ সালের মার্চ থেকে নভেম্বর মাসকে। এর ভেতর তিন পর্বে তিনি ১৪টি পর্বতারোহন করেন।

প্রথম পর্বে (মার্চ থেকে জুন) নির্মাল জয় করেন নেপালের এভারেস্ট (৮৮৪৮মি.), লোৎসে (৮৫১৬মি.), কাঞ্চনজঙ্ঘা (৮৫৮৬মি.), মাকালু (৮৪৮১মি.) ধলাগিরি (৮১৬৭মি.) ও অন্নপূর্ণা (৮০৯১মি.)। দ্বিতীয় পর্বে (জুন থেকে আগস্ট) নির্মল জয় করেন পাকিস্তানের কিলার মাউনটেইনখ্যাত কে-টু (৮৬১১মি.), নাঙ্গা পর্বত (৮১২৬মি.), ব্রড পিক (৮০৪৭মি.), জি-ওয়ান (৮০১০মি.) ও জি-টু (৮০৩৫)। সর্বশেষ ও তৃতীয় পর্বে (সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর) নির্মল জয় করেন নেপালের মানাসলু (৮১৬৩মি.), তিব্বতের শিশাপাংমা (৮০২৭মি.) ও চো ওইয়ু (৮১৮৮মি.) পর্বত।

এই ১৪ পৃথ্বিধরচূড়া জয় করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার মৃত্যু পথযাত্রী হয়েছেন নির্মল। তবে দমে যাননি, শেষ পর্যন্ত টিকে থেকেছেন তিনি। কোত্থেকে পেয়েছেন এই অদম্য প্রাণশক্তি? আমি মনে করি মানুষের চিন্তাই মানুষকে গড়ে দেয়। নির্মল বড় স্বপ্ন দেখতে পিছপা হননি। যখন সবাই বলছিল, এই প্রকল্প অসম্ভব, তখন তিনি প্রকল্পের নাম উল্টো ‘সম্ভব’ রেখে গোটা মানবজাতির সামনে এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এটি আমার জন্য শুদ্ধ দৃষ্টান্ত নয়, এক বিপুল অনুপ্রেরণা। যখনই কোনো বাঁধা আসে আমার সামনে, আমি নির্মলের কথা ভাবি। শক্তি পাই। প্রাণ পাই। গতকালের নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সংকল্প পাই।

নির্মল মনে করেন, পাহাড়ের উঁচু চূড়ায় যাওয়ার যে অভিযাত্রা, সেটি আসলে নিজের কষ্টের সঙ্গে মোকাবিলা করে, তাকে সহযাত্রী বানিয়ে সামনে এগিয়ে চলা। মানুষের দ্বারা কি সম্ভব তা দেখিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যেও অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলেন নির্মল। আরোহনের সময় আত্মা যেন খাঁচাছাড়া হয়ে পর্বতের অংশ হয়ে যায়, পর্বতই হয়ে ওঠে নতুন প্রাণ, নতুন জীবন দর্শন। নির্মল ছবির এক জায়গায় বলেন, “পর্বত বলে না—আপনি কালো, আপনি ধলো, আপনি দুর্বল, আপনি শক্তিমান। একটাই নিয়ম সেখানে বিরাজমান। যদি তুমি হাল ছেড়ে দাও, তো মৃত্যু অবধারিত।” জীবনের ক্ষেত্রেও কি একই সত্য জারি নেই?

ঝুঁকি নেয়ার নামই জীবন। নিরাপদ, নিস্তরঙ্গ দীর্ঘজীবন অনেকটা আলু-পটল-ঢেঁড়সের মতোই। নির্মল হয় তো ইউরোপীয় কেউ নন, তাই তাকে নিয়ে ইউরোপে হইচই তেমন একটা হয়নি, তবে তিনি মানবজাতির সক্ষমতাকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, সেখান থেকে আমার মতো নগণ্য মানুষ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাধাবিপত্তি এড়িয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা পাই, সেটাই বা কম কিসে? আমার ধারণা নির্মলের মতো মানুষ কেবল পর্বতারোহীদের কাছে নয়, অনুপ্রেরণার রূপক হয়ে উঠতে পারেন সাধারণ মানুষের কাছেও। শিখরে পৌঁছাতে চায় সকলেই, কিন্তু তার জন্য যে পরিশ্রম, অধ্যবসায়, একাগ্রতা দরকার, তার শিক্ষা আগে নিতে হবে। এই আরোহীরা হতে পারেন আমাদের মনোবলের শিক্ষক। একজন লেখকও তার মতো করে শিখরে ওঠার যাত্রা শুরু করেন, নিবিষ্টচিত্তের পাঠ ও হাত মকশো করার কালটাই তার প্রস্তুতিকাল। এটা অনেকেই বোঝে না। তাই অনেককেই দেখা যায় ছোট একটি পাথরের উপর দাঁড়িয়ে শিখরে চড়ার ছদ্ম-আনন্দে আত্মভোলা হতে। সে দেখতেই পায় না, অদূরে সত্যিকারের ঝুঁকি নিয়ে, পরিশ্রম করে কোনো কোনো মানুষ হাজার মিটার পাড়ি দিয়ে শিখর জয় করে বসে আছেন, আর তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন।

 

২.

অবনীধর অবলীলায় জয় করা যায় না, এটি দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর ও কষ্টসাধ্য এক খেলা বা স্পোর্টস, পাশাপাশি এটি একটি রূপকও বটে। ফ্রান্সের প্যাট্রিক ইমবার্ট পরিচালিত ‘দ্য সামিট অব গডস’ অ্যানিমেটেড ছবিতে ওই বাস্তবতা আর রূপক যেন মিলেমিশে যায়। এই ছবির নায়ক দুজন, একজন হাবু জজি, যিনি শৈলারোহনকে জীবনের একমাত্র সুখ করে নিয়েছেন এবং আরেকজন তরুণ চিত্রসাংবাদিক মাকোতো ফুকামাচি, যিনি ব্যতিক্রমী খবর ও সবার চেয়ে আলাদা ছবি পেতে পাহাড় ডিঙাতেও রাজি। একটি ভালো স্টোরির আশায় সে সারথী হয় হাবুর মরিয়া ইচ্ছার। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, শুধু খবর নয়, পাহাড়ের নেশা ধরেছে তাকেও। ছবির গল্প পুরো বলার দরকার নেই, শুধু বলতে চাই, সাংবাদিক মাকাতো যা পাওয়ার জন্য হাবুর পিছু নিয়েছিলেন, তার সন্ধান তিনি পান হাবুর সাথে ধরাধর আরোহনের বেলা। কেন হাবুর মতো বহু মানুষ মৃত্যু পরোয়ানাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে, পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে ওঠে? একবার পাহাড়ের দক্ষিণ দিক দিয়ে, তো আরেকবার দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে; একবার গ্রীষ্মে, তো আরেকবার কনকনে শীতকালে; একবার অক্সিজেন নিয়ে, তো আরেকবার অক্সিজেন ছাড়া; একবার এভারেস্ট, তো আরেকবার কে-টু; কেন? বাধা ডিঙিয়ে যাওয়াতেই আসলে ওদের আনন্দ। এই আনন্দেই ওরা খুঁজে পায় জীবনের মানে। হাবুর কাছ থেকে এই মর্মবাণীই আবিষ্কার করে মাকাতো।

দ্য সামিট অব গডস

আমার মতো সামান্য লেখকও এই আনন্দ পাই লেখালেখির সময়। যখন লিখতে থাকি, বাক্যের পর বাক্য, তখন মনে হয় হাতের বরফ-কুঠার দিয়ে ঠুকে ঠুকে বের করে আনছি যথার্থ ও উপযুক্ত শব্দ, এরপর ক্র্যাম্পন (জুতোর কাঁটা) দিয়ে ঠেলা মেরে সেগুলো বসিয়ে দিচ্ছি বাক্যে, আর দড়ির টানে এগিয়ে যাচ্ছে আমার রচনা, শিখরের দিকে। লেখা শেষ হলো, তো পর্বতারোহনের সুখ পেলাম। কিন্তু মনের কোনে আরেক ভূধর ডিঙানোর বাসনা জেগে উঠতে থাকে কিছুদিন পরই। একজন লেখকের কাছে এটাই জীবন। একজন পর্বতারোহীর কাছে ওই পাহাড়ের পাঁচিল বেয়ে উপরে ওঠাটাই জীবন।

চরম প্রতিকূল পরিবেশে একজন শৈলারোহীর একা লড়াই করে টিকে থাকা এবং নিজেকে শিখরের দিকে টেনে নেয়া, মূলত আমাদের আটপৌরে জীবনে সকল বাধা ডিঙিয়ে যাওয়ারই আরেকটি রূপ মাত্র। যারা অসামান্য সাহস নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে রূপক হয়ে ধরা দেন তাদের জন্য রইলো অসীম ভালোবাসা।