দার্শনিক ভাবনা সমৃদ্ধ পনেরো সিনেমা

সামি আল মেহেদী প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২২, ১১:২৯ এএম দার্শনিক ভাবনা সমৃদ্ধ পনেরো সিনেমা

রূপালি পর্দায় সরাসরি গল্প বলে চলার সাথে সাথে নির্মাতা অনেক সময় নির্দিষ্ট কোনো বিশ্বাস, আলোচনা বা চিন্তাকে তুলে ধরেন মূল গল্পের আবরণে। এই প্রতীকি রূপ আর ভিন্ন বক্তব্য নিখুঁতভাবে তুলে ধরাই নির্মাতার মুন্সিয়ানার পরিচয় দেয়। ‘টেস্ট অব সিনেমা’ ব্লগ অবলম্বনে এমন কিছু পরিচালকের অসামান্য কিছু সিনেমার কথা তুলে ধরা হয়েছে এখানে। 

 

১. রোপ (১৯৪৮), আলফ্রেড হিচকক

সাসপেন্সের দড়াবাজি খেলায় হিচকক ছিলেন সবচেয়ে বড় কারিগর। দর্শকের মনোস্তাত্তি¡ক পরিস্থিতি আর অনুভ‚তি নিয়ে একেবারে ছেলেখেলা করতে পারতেন তিনি, চমকে দিতে জানতেন যখন তখন কুশলী নৈপুণ্যে। ‘রোপ’ তাঁর অন্যতম সাহসী ছবি। বাস্তব সময়ের সাথে সঙ্গতি রাখতে একে অনেকটা এক শটের ছবির কায়দায় বানানো। খানিকটা আন্ডাররেটেড এই ক্লাসিকে কুশীলব ছিলেন জেমস স্টুয়ার্ট, ফার্লে গ্রেঞ্জার ও জন ডাল। সমসাময়িক কালে এর নির্মাণশৈলী ছিল অনন্য, সেই সাথে উর্ধ্বস্থ ও নিম্নস্থ মানুষের প্রতিফলনও এখানে ফুটে উঠেছিল। ‘রোপ’ সিনেমাটি ১৯২৪ সালের আলোচিত এক হত্যাকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত। ‘লিওপোল্ড-লোব কেস’ হিসেবে আলোচিত সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন শিকাগোর দুই সমকামী ছাত্র। ১৪ বছরের এক কিশোরকে তারা খুন করেছিল স্রেফ এই প্রমাণ করতে যে তারা প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন এবং এই হত্যাকাÐ থেকে চাইলেই তারা পার পেয়ে যাবে।

দর্শনগত দিক থেকে ছবিটি অপ-অস্তিত্ববাদী (অ্যান্টি এগজিসটেনশিয়ালিস্ট)। অস্তিত্ত¡বাদের তত্ত¡ অনুসরণকারী স্তম্ভিত হয়ে আবিষ্কার করেন যে, তার দুই ছাত্র তাদেরই এক সহপাঠীকে হত্যা করেছে। একটা পর্যায়ে জেমসের অনুধাবন এমন হয় যে, এই দর্শনের পাটাতনে নির্ভর করে থাকলে অনুসারীদের কেবল ভোগান্তিই জোটে, সেইসাথে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হয় তাদের আশপাশের মানুষ। নিৎশের ‘উবেরমেনশ’ তত্তে¡র বিবৃতি এবং ফ্রয়েডীয় ইঙ্গিত (ফ্রয়েডিয়ান অ্যালুশন) রয়েছে এই সিনেমায়।

 

২. দ্য ফাউন্টেনহেড (১৯৪৯), কিং ভিদর

রুশ-আমেরিকান লেখক ও দার্শনিক অ্যাইন র‌্যান্ডের মূল উপন্যাসের উপর গড়ে ওঠা ইনডিভিজুয়ালিজম তাড়িত এই মেলোড্রামাটিক আখ্যান নির্মিত হয়েছে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট স্টাইলে। ছবির প্রধান কুশীলব গ্যারি কুপার এক স্বাধীন স্থাপত্যবিদ যে নিজের সততা বজায় রাখার সংগ্রামে লিপ্ত। মার্কিন স্থাপত্যকলা, নীতি এবং রাজনৈতিক আদর্শের বিষয়ে এই সিনেমা এক অধিবস্তুবাদী (মেটাফিজিক্যাল) বক্তব্য, নান্দনিক ইশতেহারও বলা যায়।

সিনেমার বুদ্ধিদীপ্ত চরিত্রগুলো সাধারণ সংলাপ এবং ক্ষণে ক্ষণে চমকদারি পারফরম্যান্সে আলো ছড়িয়েছে পুরো সময়। ‘গেইল উইনার্ড’ চরিত্রে রূপায়নকারী রেমন্ড মেসি পুরো সিনেমায় চরিত্রগত বিবর্তনে স্মরণীয় হয়ে উঠতে পেরেছেন। ‘রোর্ক’ চরিত্রে গ্যারি কুপার প্রচলিত ধারার সাথে খাপ খাওয়ানোয় অনবরত সংগ্রামে ও সংঘাতেই নিজেকে প্রকাশ করেছেন।

 

৩. দ্য সেভেন্থ সিল (১৯৫৭), ইঙ্গমার বেরিম্যান

‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ’, ‘পারসোনা’র মতো বিখ্যাত সব ছবির স্রষ্টা ইঙ্গমার বেরিম্যান। তাঁর ‘দ্য সেভেন্থ সিল’ ছবিটিকে বলা যায় অস্তিত্ববাদের সিনেম্যাটিক মডেল, কোনো কিছুর অর্থকে সন্ধান করার এক বিচিত্র যাত্রা। এই অনন্য চলচ্চিত্রের কাহিনী এক নাইটকে ঘিরে, যে নিয়তিবহ এক দাবা খেলার রূপকে চ্যালেঞ্জ জুড়ে দিয়েছে খোদ মৃত্যুকে।

যদিও এই ছবিটি নাইট বনাম মৃত্যুর লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন মেটাফিজিক্যাল এবং দার্শনিক সওয়াল জবাব বুঝবার এক যাত্রা, তবে একই সাথে বেরিম্যান চেয়েছেন দর্শক যেন এই ছবির মধ্যে দিয়ে শয়তান, ধর্মের দর্শন এবং অস্তিত্ববাদকে বুঝে উঠতে সক্ষম হয়। বিশ্বাসের সাথে মৃত্যুর নিয়ত লড়াই কিংবা মহাবিশ্বে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে বোঝাপড়ার বিষয়টি দর্শকের যাচাইয়ের জন্য অনন্য মাত্রায় ফুটিয়ে তুলেছেন বেরিম্যান। এ ছবি অজস্র প্রশ্নের ভাণ্ডার, তবে উত্তর আর মতামত সন্ধানের দায় দর্শকের।

 

৪. লা দলচে ভিতা (১৯৬০), ফেদেরিকো ফেলিনি

‘এইট অ্যান্ড আ হাফ’, ‘এমারকর্ড’, ‘রোমা’র নির্মাতা ফেদেরিকো ফেলিনির এই নির্মাণে রোমের মানুষজনের বিলাসব্যসনে ঝলমলে জীবনের এক অন্ধকার আর হাস্যরসে পূর্ণ রূপ খুজে পাওয়া যায়। এই ছবির প্রোটাগনিস্ট হিসেবে রূপদানকারী মার্চেলো মাস্ত্রোয়ানি পেশায় রটনাবাজ সাংবাদিক, যে কি না কিসের পর কি করবে তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত, সেই সাথে অবিরত নিজেকে আবিষ্কার করে এক বাক্সবন্দী মানুষ হিসেবে। এই ছবির মধ্যে দিয়ে ফেলিনি চতুরভাবে দর্শককে সংযোগ করিয়েছেন ‘সাত নিকৃষ্ট পাপ’ বা ‘সেভেন ডেডলি সিনসে’র সাথে; যার সময়কাল সাতটি ভোর থেকে সাতটি রাত। পুরো সিনেমার ঘটনাচক্র ফুটে উঠেছে রোমের সাতটি পাহাড় সংশ্লিষ্ট এলাকায়, নাইটক্লাব আর কাফের পাশর্^বর্তী রাস্তায়। এ প্রসঙ্গে ভ্যান গগের ‘কাফে টেরেস অ্যাট নাইট’ চিত্রটির কথা মনে করা যেতে পারে। হাতে গোণা কিছু ছবিই দর্শককে দর্শন, জীবন আর মৃত্যুর রূপ পুরোটা চোখে তুলে দেখিয়ে দিতে পারে— ‘লা দলচে ভিতা’ সেই তালিকায় অন্যতম হয়েই থাকবে।

 

৫. মাই নাইট অ্যাট মড’স (১৯৬৯), এরিক রোমার

এরিক রোমার নির্মিত এই ছবির কাহিনী গড়িয়েছে এক তরুণ প্রকৌশলীকে ঘিয়ে। এক লাস্যময়ী স্বর্ণকেশী তরুণীর পিছু নেয় সে। তরুণীটি আবার ধার্মিক ক্যাথলিক, আর এই বিষয়টিও প্রকৌশলীর জন্য খুব গুরুত্ববহ। সে যাই হোক, তার এই ধারাবাহিক পিছু নেওয়ার মিশনে হঠাৎ করেই ছেদ পড়ে। বন্ধু প্যাসকালের পাল্লায় আটকে পড়ে পুরোটা বিকেল তার পেরিয়ে যায় ধর্ম এবং দর্শন নিয়ে আলাপচারিতায়। তারা ঠিক করে যে, মডের বাসায় হাজির হয়ে এই বিষয় নিয়ে তারা যুক্তি-তর্ক-গল্প আরও চালিয়ে যাবে। এই আলাপচারিতার মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কঠিন বাজি ধরে প্যাসকাল, ১০০:১ অনুপাতে! ঈশ্বর যদি না থাকেন, তাহলে তারা বাজিতে হারবে, যদিও সেই হারাটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় তাদের কাছে। আর যদি থাকেন, তাহলে তাদের জীবন অর্থবহ এবং এই বেঁচে থাকাটাও পুরস্কারের মতো বিষয় হয়ে উঠবে তাদের কাছে। এই সিনেমার চরিত্রগুলো বুদ্ধিদীপ্ত, আত্মবিশ্বাসী, প্রত্যয়ী ও চাতুর্যপূর্ণ; বলতে গেলে চরিত্রগুলোই এই ছবিকে অন্য স্তরে নিয়ে যায়।

 

৬. লাভ অ্যান্ড ডেথ (১৯৭৫), উডি অ্যালেন

রুশ সাহিত্য হোক বা চলচ্চিত্র, হোক সে দস্তয়েভস্কির সাহিত্য বা আইজেনস্টাইনের ছবি; উডি অ্যালেনের এই সিনেমা সেগুলোর প্রতি এক বুদ্ধিদীপ্ত স্যাটায়ার। উডি অ্যালেন সেই সাথে এই সিনেমায় দক্ষ হাতে মিশ্রণ ঘটিয়েছেন কাফকার উদ্বেগ ও কিয়ের্কগার্দের ভয়হীনতা; আর সব মিলিয়ে এই ছবিকে পরিণত করেছেন ওয়ার অ্যান্ড পিস, ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, ফাদার অ্যান্ড সনসে’র এর প্রতি এক ননস্টপ কমেডি হিসেবে।

অ্যালেন নিজে এই ছবিতে অভিনয় করেছেন ‘বোরিস’ নামের এক যুবকের চরিত্রে, যে কি না বয়স ত্রিশে ঠেকলেও আলো নিভিয়ে ঘুমোতে পারে না! শাস্তি আর অপরাধের ভেতর চক্কর খায় সে। পুরো ছবিতেই অ্যালেন বিভিন্ন ভিজ্যুয়াল মিডিয়ামে ভ্রমণ করেছেন। ছবির শেষভাগে যদিও তিনি ভালোবাসা ও মৃত্যু নিয়ে বলেছেন, যা মানুষ হিসেবে তার জীবন থেকে নেওয়া দীক্ষা। এই শিক্ষা এই বয়ান দেয় যে, আমাদের মন বিশাল একটা ব্যাপার হলেও পার্থিব শরীরই দিনশেষে সকল আনন্দের আধার।

 

৭. বিয়িং দেয়ার (১৯৭৯), হ্যাল অ্যাশবি

জর্জি কসিনস্কির মূল উপন্যাসের চিত্ররূপ এই সিনেমায় পিটার সেলার্স অভিনয় করেছেন এক মালীর চরিত্রে, যে কি না মালিকের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনো এস্টেট ছেড়ে বেরোয়নি। এরপর, এস্টেটের মালিক বেনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে এক বিচিত্র পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। প্রেসিডেন্ট এবং রাজনীতির চেয়ার নির্ধারণ করে দেওয়া ক্ষমতাধর লোকজন আলাপ করতে থাকেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবে তা নিয়ে। আর এই আলোচনায় তাদের কাছে প্রথম পছন্দের নাম হয়ে ওঠে মালীর নাম!

চরিত্রগুলো বা কাহিনীকে একইসাথে হাস্যরসাত্মক আবার আরেক দিক থেকে সিরিয়াস, এই দুইয়ের ভারসাম্য বজায় রেখে শেষটায় মানবতাকেই গুরুত্ব দেওয়ার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন ‘হ্যারল্ড অ্যান্ড মউড’, ‘দ্য লাস্ট ডিটেইলে’র মতো বিখ্যাত ছবির নির্মাতা অ্যাশবি। তাঁর এই ছবিটি কেবল এক দুর্দান্ত ব্যঙ্গাত্মক কমেডিই নয়, বরং এটি একইসাথে দর্শককে হেইডেগারের দর্শনের বিভিন্ন ধারণা ও অনুপ্রেরণার সাথে সাক্ষাত করিয়ে দিতে সক্ষম।

 

৮. মাই ডিনার উইথ আন্দ্রে (১৯৮১), লুই মাল 

এই ছবিতে কেন্দ্রীয় ভ‚মিকায় অভিনয়কারী আন্দ্রে গ্রেগরি এবং ওয়ালেস শন নিজেরাই লিখেছেন এর চিত্রনাট্য। এক জাঁকজমকপূর্ণ রেস্তোঁরায় দুজন পুরুষের নৈশভোজ, এই হচ্ছে পুরো ছবির প্লট; বিশ্বাস করুন আর নাই করুন! পরিসর ক্ষুদ্র হলেও তাদের আলাপচারিতা খুবই চিন্তা জাগানো বিষয়াষয় নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। মূলত এই আলাপচারিতা আন্দ্রের মহাবিশ্ব নিয়ে স্পিরিচুয়াল এবং আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গী বনাম ওয়ালেসের প্রায়োগিক মানবতা এবং বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গীর পারস্পরিক আলাপেরই দৃশ্যায়ন। আন্দ্রে এবং ওয়ালেস দুইজন দুই ঘরানার দর্শনের মানুষ—একজন খামখেয়ালী যখন কী না অন্যজন একেবারেই ধীরস্থির স্বভাবের। স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রের সমালোচকদের কাছে এই সিনেমা একটি কাল্ট ক্লাসিক হিসেবে বিবেচিত। এই ছবি দার্শনিক ভাবনায় পূর্ণ, জীবন নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আলাপ, মানুষের অবস্থান, ধর্ম ও যোগাযোগ; সবকিছুই বিশালভাবে ধরা দিয়েছে খুব ক্ষুদ্র এক পরিসরের মাঝেই। সিনেমাটির সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় হচ্ছে—এখানে একই সময়ে দুজনেই সঠিক এবং দুজনেই ভুল!

 

৯. ব্লেড রানার (১৯৮২), রিডলি স্কট

ফিলিপ কে ডিকের কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছে। অ্যান্ড্রয়েড রোবটেরা কি বৈদ্যুতিক ভেড়ার স্বপ্ন দেখে? এমন বিচিত্র প্রশ্ন এবং ভাবনা এই কল্পবিজ্ঞান ছবিকে জুগিয়েছে অস্তিত্ববাদী দর্শনের খোড়াক। সাইবারনেটিক যুগে আগমনের পর, মানুষের অনুরূপ কোনো কৃত্রিম শরীরে যদি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যুক্ত করা হয় এবং সেটি যদি মানুষের মতে দেখতে এবং আচরণ করতে সক্ষম হয়; তাহলে কি তাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করা যাবে? এই ছবিতে প্রধান ভ‚মিকায় অভিনয়কারী হ্যারিসন ফোর্ড একজন ‘ব্লেড রানার’, টাইরেল কর্পোরেশনের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারদের নির্মিত রেপ্লিক্যান্টদের (মনুষ্য-অনুরূপ রোবট) ধ্বংস করার জন্য যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

 

১০. বার্টন ফিংক (১৯৯১), এথান ও জোয়েল কোয়েন

কোয়েন ভাইদের নির্মাণে ‘ফার্গো’, ‘দ্য বিগ লেবোওস্কি’, ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড মেন’, ‘ব্লাড সিম্পলে’র মতো অসাধারণ সব ছবি উপহার পেয়েছেন দর্শক। বার্টন ফিংকের গল্প তারা দেখিয়েছেন নিজেদের অনন্য ঢংয়ে। নিজের শিল্প নিয়ে গর্ববোধকারী বার্টনের শিল্পসংশ্লিষ্ট অহংকার একেবারেই দুমড়ে যায় হলিউডের ময়দানে এসে। এই ছবিতে বার্টন ফিংক একজন বুদ্ধিজীবী, যে নিজেকে ক্ষয় করে যাওয়ার মধ্যে থেকেই এমন প্রবোধ নিজেকে দেয় যে, সে ঠিক কাজই করছে। দৈনন্দিনতার চক্রে আটকা পড়ে আমরাও মাঝেমধ্যে নিজেদের অবস্থান ও অস্তিত্ব নিয়ে ঠিক বুঝে উঠতে সক্ষম হই না। এই ছবি একইসাথে স্বর্গ ও নরকের একটি প্রতীকি রূপ হয়ে ধরা দিয়েছে।

 

১১. দ্য অ্যাডিকশন (১৯৯৫), অ্যাবেল ফেরেরা

এই ছবিতে দেখা যায়, কলেজপড়ুয়া এক দর্শনের ছাত্রী নিউ ইয়র্ক শহরে প্রায়ই ঘুরে বেড়ায়। এক রাতে সে এক নারী ভ্যাম্পায়ারের খপ্পরে পড়ে। সেই ভ্যাম্পায়ার আবার তাকে জীবনভিক্ষার জন্য সুযোগ দেয়। সে বলে, ‘তুমি আমাকে সত্যি করে, মন থেকে চলে যেতে বলো। বললেই আমি চলে যাব।’ তবে ক্যাথলিন তাকে চলে যেতে বলে না, বরং সে ভ্যাম্পায়ারের দংশনে আক্রান্ত হয়ে নিজেও ভ্যাম্পায়ার হতে চায়। ভ্যাম্পায়ার হয়ে ওঠার পর নতুন জীবনধারায় অভ্যস্ততা আর অসুস্থতার সাথে সাথে সেও রক্তের তৃষ্ণায় শহরে ঘুরে বেড়াতে থাকে। একইসাথে সে মানবতার গুরুত্ব বিষয়ে সচেতনভাবে প্রশ্ন করতে থাকে। তার ধারণা এমন যে দর্শনের আসলে কোনো উদ্দেশ্য নেই। মানব সভ্যতার ইতিহাস স্রেফ মানুষের দুর্বলতা এবং বিশৃংখলাকে আড়াল করার এক মুখোশমাত্র, কেবল যুদ্ধ আর মৃতদেহের উপরে ভিত করে তৈরি। ভ্যাম্পায়ার-মুভি হলেও অ্যাবেল ফেরেরা যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিমায় এই দার্শনিক উপলব্ধিতে ছবিটিকে পরিপূর্ণ করে তুলেছেন।

 

১২. দ্য ট্রুম্যান শো (১৯৯৮), পিটার উইয়ার

‘দ্য ট্রুম্যান শো’ ছবির নাম ভ‚মিকায় অভিনয় করেছেন জিম ক্যারি। ছবির কাহিনীই এমন যে ট্রুম্যানের সব কিছুই আসলে মিথ্যা। তার সম্পর্ক, কাজ এবং জীবন অগণিত মানুষের কাছে টেলিভিশনে দেখানো হয়। তাহলে সত্য আসলে কি? দেকার্তে থেকে সার্ত্রে, শোপেনহাওয়ার থেকে প্লেটো; এমনই সব বিখ্যাত দার্শনিকের চিন্তাগত দিক এই ছবিতে খুঁজে পাওয়া যায়। এই ছবি দর্শককে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। ঈশ^রের নির্দেশনা কি চোখকান বুজে অনুসরণ করতে হবে, নাকি সেগুলো গোণায় না ধরে নিজেরাই নিজেদের নীতিমালা ও সিদ্ধান্ত নিতে হয়? আমরা যদি নিজেরা নিজেদের নির্দেশনা অনুযায়ী চলি, তাহলে কি সেটা অপরাধ? আর এই কাজের জন্য কি আমাদের মাশুল গুণতে হয়? বিচিত্র এই ছবি দর্শককে অস্বস্তিতে ফেলে।

 

১৩. আই হার্ট হাক্যাবিস (২০০৪), ডেভিড ও’ রাসেল

এই সিনেমা অস্তিত্ববাদ আর জীবনের অর্থবহতার সুলুকসন্ধান। এতে অভিনয় করেছেন জ্যাসন শোয়ার্জম্যান, ডাস্টিন হফম্যান, জুড ল ও লিলি টমলিন। প্রকৃতি, আদর্শবাদ আর সাফল্যের সাথে ইনডিভিজুয়ালিজমের দার্শনিক তর্ক নিবিড়ভাবে নিরীক্ষা করা হয়েছে এই ছবিতে। সেই সাথে বিভিন্ন দার্শনিক এবং নন্দনতাত্ত্বিক ধারণা উঠে এসেছে এই ছবিতে। সার্ত্রে থেকে ফ্রয়েডীয় চিন্তা কিংবা স্যুররিয়ালিজমের দেখা পাওয়া যায় এখানে, পাশাপাশি বৌদ্ধ দর্শনের হাজিরাও এখানে স্পষ্ট। এই ছবি শেষতক কোন দার্শনিক তত্তে¡র মূলে অবস্থান নিয়েছে, তাও একটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়।

 

১৪. এটারনাল সানশাইন অব দ্য স্পটলেস মাইন্ড (২০০৪), মাইকেল গনড্রি

এই সিনেমার মূল কাহিনী লিখেছেন ‘অ্যাডাপটেশন’, ‘সিনেকডোকি, নিউ ইয়র্ক’, ‘বিয়িং জন ম্যালকোভিচে’র মতো নন্দিত ছবির রচয়িতা চার্লি কফম্যান। রোমান্টিক কমেডি ঘরানার এই ছবিতে অসামান্য অভিনয় করেছেন জিম ক্যারি এবং কেট উইনস্লেট। একে অন্যের স্মৃতি মুছে ফেলার এক বিচিত্র যাত্রায় অবতীর্ণ দুই সঙ্গীর এই গল্প বলার মধ্যে দিয়ে পরিচালক নিপুণভাবে স্মৃতি, সম্পর্ক, লোকসান এবং দুটি সত্ত্বার সম্পর্ককে সন্ধান করেছেন। প্রেম, বাস্তবতা আর সুররিয়ালিজমের অসাধারণ এক সংমিশ্রণ হিসেবে এই ছবিটি অগ্রগণ্য হয়ে থাকবে।

 

১৫. দ্য ফাউন্টেন (২০০৬), ড্যারেন অ্যারোনফস্কি

আত্মা ও অমরত্ব, জীবন ও মৃত্যু, শাশ^ত ভালোবাসা, জীবন-বৃক্ষ এবং তারুণ্যর উৎস ঘিরে এই সিনেমার আখ্যান। নির্মাতা অ্যারোনফস্কির ‘ব্ল্যাক সোয়ান’, ‘পাই’, ‘রিকুয়েম ফর আ ড্রিমে’র মতো এই ছবির গল্প ও এর এগিয়ে চলাও ভিন্নধমী এবং জটিল। ‘টমি’ চরিত্রে রূপায়নকারী হিউ জ্যাকম্যান কয়েকটি গল্পে জড়িয়ে আছে। কখনো সে স্ত্রীর আরোগ্যর জন্য বানরের ওপর পরীক্ষামূলক সার্জারি করছে, কখনো সে অমরত্বের সন্ধানে অভিযান চালাচ্ছে, আবার মহাকাশচারী হিসেবেও আবির্ভূত হচ্ছে। এই তিন ভূমিকাতেই তার মূল অনুসন্ধান— অমরত্ব, একইসাথে মৃত্যুর সাথে কোনোভাবেই সে আপোষ করতে রাজি নয়। প্রতিটি গল্পেই সে ভালোবাসা হারায়, যা তার সামনেই থাকে; বরং বারবার চেষ্টা করে অলৌকিক কিছু অর্জনের। ফ্যান্টাসি ঘরানার এই ছবি জীবনের উৎস, অর্থ এবং সন্ধান নিয়ে বারবারই দার্শনিক বক্তব্য তুলে ধরে।