দৃষ্টি ও অদৃষ্ট: জাক লাকাঁর ভূমিকা

সলিমুল্লাহ খান প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২, ০৮:২০ এএম দৃষ্টি ও অদৃষ্ট: জাক লাকাঁর ভূমিকা

‘সিনেমা দর্শন’ পত্রিকার পাতা যাঁহারা পড়িতেছেন তাঁহাদের অনেকের সহিত জাক লাকাঁর পরিচয় আছে। কেহ কেহ আছেন অধিক গিয়াছেন—লাকাঁর দুই চারিটি লেখাও তাঁহারা পড়িয়া থাকিবেন। আমি নিজেও এই শেষোক্তদের দলে। অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করিয়া থাকেন—‘জাক লাকাঁ ফ্রয়েডের অনুসারী, বুঝিলাম—কিন্তু তিনি নতুন কি করিয়াছেন?’ এই নিবন্ধে আমি এই প্রশ্নের আলোচনা করিতে আগ্রহী হইয়াছি।

 

ফ্রয়েড যেমন ‘অজ্ঞান’ আবিষ্কার করিয়াছেন, লাকাঁও তেমনি আবিষ্কার করিয়াছেন ‘অদৃষ্ট’। বলিয়া রাখি, অজ্ঞান মানে যেমন জ্ঞানের অভাব নয়—বরং অভাবের জ্ঞান, তেমনি অদৃষ্ট মানেও দৃষ্টির অভাব নয়—বরং দৃষ্টির আড়াল মাত্র। কথাটা বুঝাইয়া বলি। বাংলা ভাষায় ‘অদৃষ্ট’ বলিয়া যে কথাটা চালু রহিয়াছে তাহা রূপক অর্থাৎ রূপান্তরিত অর্থে। ইহার অর্থ নিয়তি। কিন্তু ‘অদৃষ্ট’ কথাটির শূন্য—অর্থাৎ আক্ষরিক—অর্থও একটা আছে। সকলেই জানেন, অদৃষ্ট মানে কপাল। চোখের ঠিক উপরে বলিয়াই হয়তো অদৃষ্ট শব্দের নিকটতম অর্থ কপাল। হইতে পারে এই কারণেই যাঁহারা তিন নম্বর একটা চোখ চাহেন সেই চোখটা তাঁহারা সচরাচর কপালেই বসাইয়া দেন।

ফ্রয়েডের আবিষ্কারের একটি ফল এই দাঁড়াইয়াছে যে মানুষ বলিতে আমরা এতদিন যাহা বুঝিতাম তাহাতে একটা বড় আকারের পরিবর্তন ঘটিয়াছে। সপ্তদশ শতাব্দীর দার্শনিক রনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০) হইতে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিজ্ঞানসাধক জর্জ-লুই বুফোঁ (১৭০৭-১৭৮৮) পর্যন্ত মানুষ বলিতে যাহা বুঝাইয়াছেন তাহা—একবাক্যে বলিতে—তছনছ হইয়া গিয়াছে। দেকার্তের বিখ্যাত বাক্য—‘আমি ভাবছি, তাহাতেই প্রমাণ আমি ভবে আছি’—যদি সত্য হয় তো আমরা ধরিয়া লইতে পারি এই বাক্যের দুই কর্তা—অর্থাৎ দুই ‘আমি’—একই ব্যক্তি। এই দুই ‘আমি’র মধ্যে কোন প্রভেদ নাই। আমি ভাবছি এবং আমি আছি—একই কর্তার দুই ক্রিয়া মাত্র।

লাকাঁ দেখাইয়াছেন, ‘আমি’ শব্দটা যিনি ভাবিতেছেন তিনি না হইয়া তাহার মুখোশও হইতে পারে অর্থাৎ যিনি বলিতেছেন ‘আমি’—তিনি নহেন—তাহার পিছনে বা আড়ালে আর কেহ ভাবিতেছেন। যিনি নাই আর যিনি আছেন—ইহারা দুই জন—মোটেও এক বা অবিভাজ্য জন নহেন। এই ব্যাখ্যায় যাঁহারা আপত্তি করেন, তাঁহারা বলেন ‘অজ্ঞান জ্ঞান’ বলিয়া কিছু থাকিতে পারে না—কারণ কথাটা স্ববিরোধী। লাকাঁ বলেন, মোটেও না। আমার যে জ্ঞান আছে তাহা আমি নাও জানিতে পারি। এই ধরণের জ্ঞানই ‘অজ্ঞান জ্ঞান’। যেখানে জ্ঞান জানে না তাহার জ্ঞান আছে তাহাই ‘অজ্ঞান জ্ঞান’। মানুষ যে স্বপ্ন দেখে তাহা অজ্ঞান জ্ঞানের সার্বজনীন উদাহরণ। ফ্রয়েডের আবিষ্কারের মধ্যে স্বপ্নের ভ‚মিকা অনেক বড়। উদাহরণ আরো আছে।

 

একইভাবে আরেক মনস্বী—উপরোক্ত মহাত্মা বুফোঁ—দাবি করিয়াছিলেন, মানুষের ভাষার চেহারা নির্ভর করে স্বয়ং বক্তার ব্যক্তিত্বের উপর। লাকাঁ দেখাইয়াছেন কথাটা অর্ধেক মাত্র সত্য। আমার ভাষার চেহারা নির্ভর করে আমি যাঁহাদের সামনে রাখিয়া লিখিতেছি তাঁহাদের উপর। মজার বিষয়, আমার এই লেখা মাত্র ‘সিনেমা দর্শন’ পত্রিকার পাঠকেরা পড়িবেন (পাঠিকারা ক্ষমা করিবেন) এমন নহে। ইহা কে কে যে পড়িবেন—বা পড়িবেন না—তাহাদের  সংখ্যা গুনিয়া শেষ করা যাইবে না। যাঁহাদের আমি চোখে—বলিতে পারেন মানসনেত্রে—দেখিতেছি, তাঁহারা তো বটেই—আরো কত লোকে, আরও কত দিন—আরো অনেকেই এই লেখা পড়িবেন। তাহারা তো আমাকে দেখিতেছেন কিন্তু আমি তাহাদিগকে দেখিতেছি না। অধিক কি, আমার জন্মের আগে আমার মা ও বাবাকে আমি দেখি নাই—কিন্তু তাঁহারা মানসনেত্রে আমাকে দেখিয়াছেন। আরস্তুতালেস আমাকে দেখেন নাই—লাকাঁও দুর্ভাগ্যবশত—কিন্তু আমি এখনও তাঁহাদের উভয়কে দেখিতেছি। এই ঘটনাকেই বলে অদৃষ্ট। যাহারা খটকায় পড়িতেছেন তাহাদের জন্য টোটকা আছে। ‘অদৃষ্ট’ শব্দটি বিশেষণ বিশেষ। এক্ষণে আমি তাহাকে বিশেষ্যরূপে ব্যবহার করিতেছি। ধরিয়া লইবেন—যদি প্রয়োজন হয়—‘অদৃষ্ট’ মানে ‘অদৃষ্ট দৃষ্টি’। আর এই নিবন্ধের শিরোনামে ‘দৃষ্টি’ নামে যে শব্দটি লিখিয়াছি তাহার অর্থ ‘দৃষ্ট দৃষ্টি’।

বাংলা ভাষায় এই কথাগুলি আমি আমার প্রয়োজনে ব্যবহার করিতেছি মাত্র। কিন্তু আমার আগেও বাংলায় ছিল। হয়তো ছিল অদৃষ্টই। এইগুলির উৎস জাক লাকাঁর ব্যবহার্য ফরাশি ভাষায়ও পাওয়া যাইবে। আর কোনদিন আর কোন উপলক্ষে তাহার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা যাইবে।

 

জাক লাকাঁ যখন পড়াইতে শুরু করিলেন তখন—ইহা ১৯৫৩-৫৪ সালের কথা—তিনি জাঁ-পল সার্ত্রের দোহাই দিয়া ‘দৃষ্টি’ বলিতে কি বোঝায় তাহা স্পষ্ট করিবার কোশেস করিয়াছিলেন। সার্ত্রের শিক্ষা অনুসারে ‘দৃষ্টি’ মানে যুগপদ ‘দৃষ্ট’ও বটে। আমি যাহার দিকে চোখ ফেলিতেছি তিনিও আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতেছেন। দৃষ্টি তাই একই সঙ্গে দৃষ্টও। এই ব্যতিহারকে সার্ত্রের অভিজ্ঞতার দর্শনের প্রাণ বলা যাইতে পারে। সার্ত্রের সম্মানে জাক লাকাঁ বলিয়াছেন “দৃষ্টি” বলিতে সার্ত্র শুদ্ধ দৃষ্টি নয়, পায়ের শব্দসহ আরও যাহা কিছু আপনাকে হুঁশিয়ার করে তাহাও দৃষ্টির অন্তর্গত বলিয়া ধরিয়া লইয়াছিলেন। ইহা লাকাঁর প্রশংসা অর্জন করিয়াছিল। কিন্তু ইহাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকেন নাই।

আমি যাহাকে দেখি, তিনি তাহার জায়গা হইতে ফিরিয়া আমাকে দেখিতেছেন—শিশু যেমন মাকে দেখে আর মা শিশুকে—জাঁ-পল সার্ত্রের লেখায় দৃষ্টির এই ব্যতিহার বা পারষ্পরিকতা আছে—কোন তৃতীয় পক্ষ নাই। এই না থাকার একটা উৎপত্তিস্থল উনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক হেগেলের রচনায় পাওয়া যায়। সেখানে প্রভুর সহিত ভৃত্যের এই দৃষ্টিবিনিময় ঘটে। এই দ্বিদলীয় দৃষ্টির পরিণতিতে একজন প্রভু এবং অন্যজন ভৃত্যের স্থান গ্রহণ করে। তখনও তৃতীয় পক্ষ কিংবা রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় নাই। যখন রাষ্ট্র প্রথম জন্ম লইল তখনও সেই প্রথম আলো ভৃত্যের মুখে পড়িল। প্রভু পিছনে পড়িলেন।

জাঁ-পল সার্ত্রের “অস্তি ও নাস্তি” নামক দার্শনিক গ্রন্থে যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায় তাহার সহিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গিরও ঢের সাযুজ্য পাওয়া যায়। পাঠককুলের অনুগ্রহ প্রার্থনা করিয়া ঠাকুরের একটি সঙ্গীত এখানে নকল করিয়া দিলাম। দৃষ্টি ও অদৃষ্টের মধ্যে ঠাকুরও এখানে একটা সমতার কল্পনা করিয়াছেন। পার্থক্যের মধ্যে, প্রভু ও ভৃত্যের লড়াইকে ঠাকুর এতদ্দেশে প্রেমের আড়ালে ঢাকা দিয়াছেন মাত্র। ঠাকুর গাহিয়াছেন:

এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে

    কী উৎসবের লগনে ।।

সব আলোটি যেমন ক’রে ফেল আমার মুখের ’পরে,

তুমি আপনি থাকো আলোর পিছনে ।।

    প্রেমটি যেদিন জ্বালি হৃদয়-গগনে

         কী উৎসবের লগনে

সব আলো তার কেমন ক’রে পড়ে তোমার মুখের ’পরে,

    আমি আপনি পড়ি আলোর পিছনে ।।

 

ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গির সহিত সার্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গির এই সাযুজ্য কাহারও কাহারও খানিক আকস্মিক মনে হইতে পারে। কিন্তু অনুসন্ধান করিলে আরো নতুন কথা পাওয়া যাইতে পারে। এক্ষণে বলিয়া রাখা যায়, জাক লাকাঁ এই ব্যতিহার বহুব্রীহিতে মজেন নাই। ১৯৬৪ সালের দিকে তিনি আরো পরিষ্কার করিলেন কোথায় তাঁহার আপত্তি—আর কোথায়ই বা তাঁহার নতুন কথা। এই নতুন কথার নামই ‘অদৃষ্ট দৃষ্টি’ বা সংক্ষেপে ‘অদৃষ্ট’।

ফ্রয়েডের আবিষ্কৃত ‘অজ্ঞান’ হইতে কি করিয়া লাকাঁর ‘অদৃষ্ট’ দেখা দিল তাহা ভারি মজার জিনিশ। জন্মের আগে তো বটেই জন্মের পরও অনেকদিন—ধরা যাক ছয় মাস বয়স পর্যন্ত—শিশুর যাহাকে বলে জ্ঞান তাহা আকার পায় না। পাওয়ার আগ পর্যন্ত মা আর শিশু একাকার অথবা নিরাকার থাকে। মায়ের গলার স্বর, চোখের দৃষ্টি, হাতের স্পর্শ—এইগুলি আলাদা আলাদা পদার্থ হইয়া শিশুর মনোহরণ করে। শিশুর নিজের দেহও তাহার কাছে ততদিন পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড আকারে হাজির থাকে।

শিশু যখন মাকে মা ডাকিতে পারে—মনে রাখিবেন—তখনই আকারের জন্ম হইয়া গিয়াছে। তখন খণ্ড খণ্ড মা একত্রিত হইয়া একটি অখণ্ড মায়ের রূপ বা সাকার মূর্তি হইয়াছে। খণ্ডগুলি কোথায় যেন হারাইয়া যায়। স্তন্যপায়ী মানবশিশু মাতৃস্তন শুদ্ধ যাহা যাহা হারায় তাহা সে অজ্ঞানলোকে খোঁজে—যাহা হারায় তাহা সে আর কখনো পায় না। এই হারানো কামনার ধনই হইয়া ওঠে তাহার সোনার হরিণ। সহজ বাংলায় ইহাকেই ‘ধন’ বা ধ্বজা বলে। বাংলা ভাষায় ধন্যবাদ কথাটার উৎস এখানেই। ইহার বিকল্প অনেক, তাহারা ইহার স্থান পূরণ করে কিন্তু বাসনা পূরণ হয় না। আকারের আবির্ভাব নিরাকারের অবসান ঘটায় আর হারানো নিরাকার চোখের সামনে— দৃষ্টির প্রান্তরে—সাকার (বা সোনার হরিণ) আকারে ছুটিয়া বেড়ায়। যেখানে মায়ের সহিত শিশুর হইত দৃষ্টিবিনিময়—ঘটিত দৃষ্টির ব্যতিহার—সেখানে এখন ভাষা, আকার বা বাবা প্রবেশ করিয়াছেন। সেই দ্বিদলীয় দৃষ্টির একটি হারাইয়াই গিয়াছে। শিশু তাহাকে খোঁজে—কোথায়ও পায় না। কিন্তু মা তাহাকে ঠিকই দেখিতেছেন। মা কেন জগতশুদ্ধ তাহাকে দেখিতেছে। এই দৃষ্টি শিশুর ‘অদৃষ্ট’।

ফ্রয়েডের কারণে আমরা দেখিয়াছি, শিশু যখন ভাষায় প্রবেশ করে তখনই সে দ্বিধাবিভক্ত হয়। তাহার একভাগ ভাষার কর্তৃত্ব মানিয়া লয়—আরেক ভাগ তাহাকে ছাড়াইয়া যাইতে চাহে। জাক লাকাঁ দেখাইয়াছেন এই বিভক্তির আরো একটা পরিণতি আছে। ভাষা শুদ্ধ কর্তাকে দুই ভাগ করে না, কর্মকেও দুই ভাগে ভাগ করে। কর্তার—অর্থাৎ শিশুর যে ভাগ ভাষার অধীন হইয়াছে তাহার উপর শিশুর কোন নিয়ন্ত্রণ নাই। শিশু বরং তাহার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। একই কায়দায়—জাক লাকাঁ দেখাইয়াছেন—শিশুর অপর অর্থাৎ তাহার মাও দুই ভাগে ভাগ হইয়া যান। সেখানেও—অর্থাৎ দ্বিতীয় ভাগের ওপরও—শিশু কর্তৃত্ব হারায়। ইহার একটা উদাহরণ মায়ের দৃষ্টি। মা আছেন কিন্তু সেই অখণ্ড দৃষ্টি আর নাই। শিশু সেই দৃষ্টি খুঁজিয়া বেড়ায় কিন্তু কোথায়ও তাহাকে পায় না। সেই দৃষ্টি এতদিনে ‘অদৃষ্ট’ হইয়াছে।

‘আমি’র দুই ভাগকে যদি বলি ‘সজ্ঞান আমি’ আর ‘অজ্ঞান আমি’, তবে দৃষ্টির দুই ভাগকেও বলা চলে ‘দৃষ্ট দৃষ্টি’ আর ‘অদৃষ্ট দৃষ্টি’। কর্তার যেমন দুই ভাগ, কর্মেরও তেমনি দুই ভাগ দাঁড়ায়। ‘কর্তা’ ও ‘কর্ম’—কথা দুইটি আমি বাংলা ব্যাকরণ হইতে আহরণ করিয়াছি। বাংলা ভাষার আরও সম্পদ আছে যাহার কল্যাণে আমরা বলি অদৃষ্টের অপর নাম ‘কর্মফল’। আমি এখানে ফলটা পাড়িয়া শুদ্ধ কর্মটাই এস্তেমাল করিতেছি। জাক লাকাঁর লেখা যাঁহারা পড়িবেন, তাঁহারা দেখিবেন তিনি ইহার নাম রাখিয়াছেন লোবজে পুতি অর্থাৎ ‘ছোটকর্ম’। শুদ্ধমাত্র দৃষ্টি হইতে উদ্ভূত ‘অদৃষ্ট’ নয়, ইহা অন্য যে কোন ছোটকর্ম হইতে পারে। তাই তিনি বীজগণিতের প্রতীক ‘a’ অক্ষরে ইহার নির্দেশ করিয়াছেন। ছোটকর্মের নাম ‘a’—ছোট হরফেই লেখা হয়।  

এই আবিষ্কারের পথে তিনি তাঁহার—অকালমৃত্যুর শিকার—বন্ধু দার্শনিক মরিস মের্লো-পঁতির ঋণ স্বীকার না করিয়া থাকেন নাই। মের্লো-পঁতি ১৯৬১ সালে এন্তেকাল করিয়াছিলেন। ১৯৬৪ সালের দিকে উঁহার ‘দৃশ্যমান ও অদৃশ্য’ নামে পূর্বে অপ্রকাশিত একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ঐ প্রবন্ধে তিনি দেখাইয়াছেন জগতের একটি চোখ আছে যাহা নিয়ত আমাদের দেখিতেছে। ইহাকে আমরা লোকের চোখও বলিতে পারি। বাংলা ভাষায়ও আমরা বলি ‘লোকচক্ষু’। লাকাঁ এই ধারণাটি লুফিয়া লইলেন। তিনি দেখাইলেন এই অদৃশ্য চোখ আসলে চক্ষুমাত্র নহে। ইহা যে আমাদের দেখিতেছে তাহাই সত্য। তাহার উপরে নাই। একই নিঃশ্বাসে তিনি বলিলেন, ইহা আমাদের কামনার ধন, বাসনার রূপ, ইহা সেই সোনার হরিণ। ইহাই সেই অভ্রভেদী ধ্বজা। ইহা মায়ের সেই হারানো চোখ। ইহা অদৃশ্য মাত্র নহে, ইহা আমাদের অদৃষ্ট।

লাকাঁর আবিষ্কারটা কোথায়? দৃষ্টি এখন সার্ত্র কিংবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিদলীয়তা ত্যাগ করিয়া তিন দলীয় হইয়াছে। লাকাঁ এক জায়গায় বলিয়াছেন, “আমি তোমাকে দেখি এক জায়গায়, তুমি আমাকে সেই জায়গা হইতে দেখিতেছ না, দেখিতেছ আরেক জায়গা হইতে।”এই ত্রিভুজের সহিত খ্রিস্টানদের ধর্মতত্ত্বের পবিত্র পরিবার জড়িত বলিয়া একটা ব্যাখ্যা কেহ কেহ—যেমন প্রসিদ্ধ দার্শনিক আলেকসান্দর কোজেব—দিয়াছেন। সেই প্রস্তাবের চমক চমৎকার হইলেও আমরা এখানে তাহা স্থগিত রাখিব।

এক্ষণে সারসংক্ষেপ করি তো দেখিতে পাই জাক লাকাঁর আবিষ্কারের মধ্যে তিনটি প্রস্তাব আছে। এক নম্বরে আছে—দৃষ্টি দুই প্রকারের, দৃষ্টি ও অদৃষ্ট। দুই নম্বর কথা—‘অদৃষ্ট’ জিনিশটা ঠিক দৃষ্টি নহে, একটা কর্ম বা কর্মফলের অপর নাম। সবশেষে—এই ‘অদৃষ্ট’ আমাদের কামনার ধন, আমাদের সাধনার লক্ষ্য, আমাদের যাবতীয় বাসনার কারণ। মনে রাখিতে হইবে বাসনা আর বাসনার কারণ—এই দুইটি কথা কিন্তু সমার্থক নহে। অদৃষ্টকে আমরা একই সঙ্গে অস্পৃশ্য, অকাট্য, অলভ্য, অপ্রাপ্য সবই বলিতে পারি। অদৃষ্টকে আমরা কোনদিনই পাইব না। কিন্তু অদৃষ্টের কারণেই—বলিতে পারেন তাড়নায়—আমরা বাসনা করিব।

এই বাসনার একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় শার্ল বোদলেয়ারের একটি ছোট্ট—সনেট গোত্রীয়—কবিতায়। কবিতার নাম ‘অন্ধজন’। ইহা তাঁহার ‘লে ফ্লর দো মাল’ গ্রন্থের ‘প্যারিচিত্র’ অংশে পাওয়া যাইবে। বোদলেয়ারের মিহি পদ্যটি আমি এখানে মোটা গদ্যে তর্জমা করিয়া দিতেছি।

 

উহাদের কথা ভাবো, মন আমার, দেখিতে সত্যি ভয়াবহ,

নকল মানবমূর্তি যেন, খানিক হাসিরও বটে;

ভয়ানক, বিদঘুটে—মনে হয় ঘুমাইয়া হাঁটিতেছে,

কে জানে, অন্ধকারে, আচ্ছন্নগোলক ছুঁড়িয়া ওরা যায় যে কোথায়?

 

উহাদের চোখ নিবিয়াছে, ওখানে আর নাই দেবলোকজ্যোতি

যেন বা দূরে কোথায় দেখিতেছে তুলিয়া মাথা—দেখিতেছে

আকাশের পানে, উহারা উন্নত মাথা কদাচ নীচু করিবে না

স্বপ্নে ভারি ঢুল ঢুলু চোখ পথের মাটির বুকে রাখিবে না।

 

এইভাবে উহারা দিতেছে অন্তহীন অন্ধকার কালোর প্রান্তর

পাড়ি—অনাদি অসীম নৈঃশব্দের ভাই এই কালো। হে শহর!

ইহারই ভিতর আমাদের তুমি ডুবায়িছ গানে গীতে, রঙ্গেবাদ্যে।

 

বিলাস-ব্যসনে মত্ত হে শহর তুমি নিষ্ঠুর বাড়িয়াছ বড় ধনে

দেখ চলিয়াছি উহাদের পিছু পিছু আমিও—ঢের হতভম্ব—

আর বলি—কি খুঁজিছে আকাশপানে এই দুনিয়ার যত অন্ধ।

 

লাকাঁর ভূমিকা এখানে আরও স্পষ্ট হইতেছে। দৃষ্টি যদি হয় কর্তার, তবে অদৃষ্ট কর্মের দিক হইতেই আসে। কর্তার কামনা এই কর্ম। এই কর্ম বা অদৃষ্টকে ঘিরিয়াই তাহার বাসনা ঘুরিতে থাকে। অদৃষ্ট বলিতে লাকাঁ যাহা নির্দেশ করিয়াছেন তাদের প্রথম পর্যায়ে আছে দৃষ্টি বা চোখের সহিত অদৃষ্ট বা কর্মফলের বিচ্ছেদ। এই বিচ্ছেদ বস্তুত নতুন কিছু নহে। ভাষায় প্রবেশ করিবার সময় শিশু যাহা হারাইয়া ফেলিয়াছিল—সেই মায়ের স্বর, মায়ের দৃষ্টি, মাতৃস্তন—তাহাই এখন বাসনার কারণ বা অদৃষ্ট আকারে সামনে হাজির হইয়াছে। তাহাকে সে আর কোনদিন পাইবে না—একথা সত্য। কিন্তু এই অদৃষ্টও তাহাকে ছাড়িবে না, আমৃত্যু আজীবন।

এই জায়গায় পৌঁছিয়া আমরা জাক লাকাঁর আরো একটা প্রস্তাবের দেখা পাই—এই প্রস্তাবে প্রকাশ সত্য এক জিনিশ আর জ্ঞান আরেক জিনিশ। মানুষের সত্য তাহার বাসনা, এই বাসনা ‘অপর লোক’ হইতে আসে। আমি যে অপরলোকের বাসনায় চলি, তাহাকে আপন বাসনা বলিয়া শান্তি পাই—তাহার নিদর্শনও পদে পদে। ‘আমি চাই’ বলিতে বলিতে যাঁহারা অজ্ঞান, তাঁহারা আসলে বলিতেছেন অপরলোক আমার কাছে কি চাহে? আমার বাণী আমার কাছেই ফিরিয়া আসিতেছে—অপরের দরবার হইতে—তবে বাক্যটা মাত্র উল্টাইয়া যায়—এই যাহা। ইহাকেই ব্যাকরণে বলে কর্তা-কর্ম বিপর্যয়।

জাক লাকাঁর আবিষ্কার লইয়া যাঁহারা আরো ভাবিতেছেন তাঁহাদের জন্য আরও একটি উপহার আমি এখানে পেশ করিতেছি। ইহার রচয়িতা মহর্ষি উপাধিতে মশহুর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইংরেজি ১৮৯৪ সালে লিখিত ও লেখকের পরলোকযাত্রার পর ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত ‘আত্মজীবনী’ নামক গ্রন্থে তিনি সাক্ষ্য দিয়াছেন ‘অদৃষ্ট’ কাহাকে বলে। উদ্ধৃতি খানিক দীর্ঘ হইবে। ইহার জন্য আমি আদৌ লজ্জা প্রকাশ করিতেছি না। ঘটনাটা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা প্রিন্স উপাধির অধিকারী মহাত্মা দ্বারকানাথ ঠাকুর বিগত  হইবার কিছুদিন পরের। ঠাকুর লিখিতেছেন: “এই আলোচনা ও শোচনাতে রাত্রিতে আমার ভাল নিদ্রা হয় না। একে পিতৃবিয়োগ, তাহাতে এই লৌকিকতাতে সারাদিন পরিশ্রম ও কষ্ট, তাহার উপরে আমার এই আন্তরিক ধর্ম্ম-যুদ্ধ। ধর্ম্মের জয়, কি সংসারের জয়, কি হয় বলা যায় না, এই ভাবনা। ঈশ্বরের কাছে এই প্রার্থনা করিতেছি, ‘আমার দুর্ব্বল হৃদয়ে বল দাও, আমাকে আশ্রয় দাও।’

 

এই পর্যন্ত গেল পটভ‚মি। এক্ষণে আমরা তাঁহার স্বপ্নের বিষয়টি পড়িব। এখানে বলিয়া রাখি, এই লেখা যখন প্রস্তুত হইতেছে তখনও ফ্রয়েডের ‘খোয়াবনামা’ রচিত হয় নাই। বলা বাহুল্য, তবু বলি—দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী প্রকাশের গোটা দুই বছর পর ফ্রয়েডের যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘খোয়াবনামা’ ছাপা হইয়াছিল। ঠাকুর লিখিতেছেন:

“এই সকল চিন্তাতে শোচনাতে রাত্রিতে নিদ্রা হয় না। বালিসের উপরে মাথা ঘুরিতে থাকে। রাত্রিতে এক বার তন্দ্রা আসিতেছে, আবার জাগিয়া উঠিতেছি। নিদ্রা জাগরণের যেন সন্ধিস্থলে রহিয়াছি। এই সময়ে সেই অন্ধকারে একজন আসিয়া বলিল, ‘উঠ’; আমি অমনি উঠিয়া বসিলাম। সে বলিল, ‘বিছানা হইতে নাম’; আমি বিছানা হইতে নামিলাম। সে বলিল, ‘আমার পশ্চাতে পশ্চাতে এসো’; আমি তাহার পশ্চাতে পশ্চাতে চলিলাম। বাড়ীর ভিতরের যে সিঁড়ি তাহা দিয়া সে নামিল, আমিও সেই পথে নামিলাম। নামিয়া তাহার সঙ্গে উঠানে আসিলাম, সদর দেউড়ীর দরজায় দাঁড়াইলাম। দরওয়ানেরা নিদ্রিত। সে সেই দরজা ছুঁইল, অমনি তাহার দুই কপাট খুলিয়া গেল। আমি তাহার সঙ্গে সঙ্গে বাহির হইয়া বাড়ীর সম্মুখে রাস্তায় আইলাম। ছায়া-পুরুষের ন্যায় তাহাকে বোধ হইল। আমি তাহাকে স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছি না, কিন্তু সে আমাকে যাহা বলিতেছে, তৎক্ষণাৎ আমাকে তাহা বাধিত হইয়া করিতে হইতেছে। এখান হইতে সে ঊর্দ্ধে আকাশে উঠিল, আমিও তাহার পশ্চাতে আকাশে উঠিলাম। পুঞ্জ পুঞ্জ গ্রহ নক্ষত্র তারকা সকল দক্ষিণে বামে সম্মুখে সমুজ্জ্বল হইয়া আলোক দিতেছে, আমি তাহার মধ্য দিয়া চলিতেছি। যাইতে যাইতে একটা বাষ্প-সমুদ্রের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। সেখানে আর তারা নক্ষত্র কিছুই দেখিতে পাই না। বাষ্পের মধ্যে খানিক দূর যাইয়া দেখি যে, সেই বাষ্প-সমুদ্রের উপদ্বীপের ন্যায় একটি পূর্ণচন্দ্র স্থির হইয়া রহিয়াছে। তাহার যত নিকটে যাইতে লাগিলাম সেই চন্দ্র তত বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। আর তাহাকে গোলাকার বলিয়া বোধ হইল না; দেখিলাম, তাহা আমাদের পৃথিবীর ন্যায় চেটাল। সেই ছায়াপুরুষ গিয়া সেই পৃথিবীতে দাঁড়াইল, আমিও সেই পৃথিবীতে দাঁড়াইলাম। সেই সমুদায় ভূমি শ্বেত প্রস্তরের; একটি তৃণ নাই; না ফুল আছে, না ফল আছে, কেবল শ্বেত মাঠ ধূ ধূ করিতেছে। তাহার যে জ্যোৎস্না তাহা সে সূর্য্য হইতে পায় নাই; সে আপনার জ্যোতিতে আপনি আলোকিত; তাহার চারিদিকে যে বাষ্প তাহা ভেদ করিয়া সূর্য্যরশ্মি আসিতে পারে না। তাহার নিজের সে রশ্মি অতি স্নিগ্ধ; এখানকার দিনের ছায়ার ন্যায় সেখানকার সে আলোক। সেখানকার বায়ু সুখস্পর্শ। মাঠ দিয়া যাইতে যাইতে সেখানকার একটা নগরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। সকল বাড়ী সকল পথ শ্বেত প্রস্তরের,—স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। রাস্তায় একটি লোকও দেখিলাম না। কোন কোলাহল নাই, সকলই প্রশান্ত। রাস্তার পার্শ্বে একটা বাড়ীতে আমার নেতা প্রবেশ করিয়া তাহার দোতালায় সে উঠিল, আমিও তাহার সঙ্গে উঠিলাম। দেখি যে, একটা প্রশস্ত ঘর; ঘরে শ্বেত পাথরের টেবিল ও শ্বেত পাথরের কতকগুলা চৌকি রহিয়াছে। সে আমাকে বলিল, ‘বসো’। আমি একটা চৌকিতে বসিলাম। সে ছায়া বিলীন হইয়া গেল। আর সেখানে কেহই নাই। আমি সেই নিস্তব্ধ গৃহে নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া আছি; খানিক পরে দেখি যে, সেই ঘরের সম্মুখের একটা দরজার পর্দ্দা খুলিয়া উপস্থিত হইলেন আমার মা। মৃত্যুর দিবস তাঁহার যেমন চুল এলোনো দেখিয়াছিলাম, সেইরূপ তাঁহার চুল এলোনোই রহিয়াছে। আমি তো তাঁহার মৃত্যুর সময়ে মনে করিতে পারি নাই যে, তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর যখন শ্মশান হইতে ফিরিয়া আইলাম, তখনো মনে করিতে পারি নাই যে তিনি মরিয়াছেন; আমার নিশ্চয় যে তিনি বাঁচিয়াই আছেন। এখন দেখিলাম, আমার সেই জীবন্ত মা আমার সম্মুখে। তিনি বলিলেন, ‘তোকে দেখ্‌বার ইচ্ছা হইয়াছিল, তাই তোকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছি। তুই নাকি ব্রহ্মজ্ঞানী হইয়াছিস্? কুলং পবিত্রং জননী কৃতার্থা!’ তাঁহাকে দেখিয়া তাঁহার এই মিষ্ট কথা শুনিয়া, আনন্দ-প্রবাহে আমার তন্দ্রা ভাঙ্গিয়া গেল। দেখি যে, আমি সেই বিছানাতেই ছট্ ফট্ করিতেছি।”

 

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন এই স্বপ্নটি দেখিতেছিলেন তখন তাঁহার জীবনের ক্রান্তিকাল চলিতেছে। জাক লাকাঁ কথিত আরও একটি সুসমাচার এখানে মূর্তি লাভ করিয়াছে। অদৃষ্ট শুদ্ধমাত্র বাসনার কারণ নহে, তাহা উদ্বেগের সঞ্চারও করে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের “আত্মজীবনী” গ্রন্থের সম্পাদক সতীশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী মহোদয় লিখিয়াছেন, ‘পিতৃশ্রাদ্ধের পূর্ব্বে দেবেন্দ্রনাথের মনে যখন ঘোর সংগ্রাম চলিয়াছে, তখন তিনি একদিন স্বর্গগতা জননীকে স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন। আত্মজীবনীর ঐ স্থানে দেবেন্দ্রনাথ লিখিয়াছেন যে মাতার মৃত্যুকালে তিনি মনে করিতে পারেন নাই সে সত্যসত্যই মাতা মরিয়াছেন। ইহা পড়িয়া আপাততঃ এরূপ মনে হইতে পারে যে, দেবেন্দ্রনাথ অতি অল্প বয়সে মাতৃহীন হইয়া থাকিবেন। কিন্তু বস্তুতঃ তাহা নহে। মাতার মৃত্যুকালে (আনুমানিক ১৮৩৯ সালে) দেবেন্দ্রনাথ ধর্মাকাঙ্ক্ষাসম্পন্ন যুবা পুরুষ; বিশ্বাসবলে তিনি তখন অনুভব করিতেছিলেন যে মৃত্যুর পরেও মাতা নিশ্চয়ই জীবিতা আছেন।”

এক্ষণে মাতার সামান্য পরিচয়—সতীশচন্দ্র চক্রবর্ত্তীর জবানি অনুসারে—সংগ্রহ করিয়া এই পরিচ্ছেদের সমাপ্তি করিতে চাহিতেছি। দেবেন্দ্রনাথের জননী দিগম্বরী দেবী যশোহর জেলার অন্তর্গত নরেন্দ্রপুর গ্রামের রামতনু রায়চৌধুরীর কন্যা ছিলেন। তিনি স্বধর্ম্মে দৃঢ় নিষ্ঠাবতী ও তেজস্বিনী নারী ছিলেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর যখন সাহেবদিগের সহিত একত্রে আহার করিতে লাগিলেন, তখন দিগম্বরী দেবী “স্বামীর সহিত সকল সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন করিয়া, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বনে জীবন নির্ব্বাহের ব্রত ধারণ করিয়া, মৃত্যুর দ্বারা তাহা উদ্যাপন করিয়াছিলেন।”

দিগম্বরী নামটি চমৎকার। ‘অদৃষ্ট’ পদের সহিত ইহার চরম যোগ আছে। দিগম্বর মানে যাহার আকাশ ছাড়া আর কোন আবরণ নাই। অর্থাৎ যাহার দিকে তাকানো যায় না। অদৃষ্টও সেই একই পদার্থ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর অদৃষ্টের দেখা পাইয়াছিলেন। এখানে বলিয়া রাখিতে হইবে দ্বিগম্বরী দেবীর মৃত্যু আর দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যুকালের ব্যবধান প্রায় আট বছরের। স্বপ্নের সহিত উদ্বেগের যোগ এখানেও দেখি অপ্রত্যক্ষ নয়।

 

আড়াই হাজার বছর আগেকার রাষ্ট্রপতি ইদিপাস নাটকেও এই অদৃষ্টের খেলাই দেখিতে পাওয়া যায়। নাটকের একেবারে গোড়ার দিকে যখন কথা উঠিয়াছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি লায়সকে কে খুন করিয়াছে তাহা খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে, নহিলে দেশে যে মহামারী দেখা দিয়াছে তাহা বন্ধ হইবে না। তখন ইদিপাস বলিয়া ওঠেন, ‘আমি তাঁহার কথা শুনিয়াছি বটে; কিন্তু তাঁহাকে কোনদিন দেখি নাই।’ ‘সিনেমা দর্শন’ পত্রিকার পাঠককুল জানেন, রাষ্ট্রপতি লায়সকে রাষ্ট্রপতি ইদিপাসই খুন করিয়াছিলেন। কিন্তু ইদিপাস তাহা জানেন না। তাই তিনি যাহা বলিতেছিলেন—“তাঁহাকে কোনদিন দেখি নাই”—সেই কথাটাও মিথ্যা নহে। এক্ষণে দেখা যাইতেছে, আপনি দেখিয়াছেন কি দেখেন নাই তাহা আরেকটি ঘটনার উপর নির্ভরশীল। ঘটনাটি এই—আপনি কি জানেন? লায়স যে তাঁহার বাবা, তাহা ইদিপাস জানিতেন না। এমন কি তিনি যে থিবিদেশের রাষ্ট্রপতি তাহা পর্যন্ত ঘটনার অনেক বছর পরও তিনি জানিতে পারেন নাই। অথচ আমরা জানি, ইদিপাস মিথ্যা বলিবার লোক নহেন।

নাটকের দুই তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হইতেছে। এমন সময়ে খবর আসিল—পাশের দেশ করিন্থ হইতে দূত আসিয়া খবর দিলেন— রাষ্ট্রপতি পলুবস এন্তেকাল ফরমাইয়াছেন। এই ভদ্রলোককেই ইদিপাস আপনার বাবা বলিয়া জানিতেন। এমন কি সন্দেহের অধীন হইয়া তিনি একদিন যখন অ্যাপলোর মন্দিরে হাজির হইয়াছিলেন তখনও তাঁহাকে কেহ বলেন নাই যে পলুবস তাঁহার বাবা নহেন। দৈববাণী বরং নিশ্চয় এই ছিল যে ইদিপাস আপনকার পিতাকে হত ও মাতাকে বরণ করিবেন। এতক্ষণে দৃষ্টসত্য অর্থাৎ কল্পিত পিতার মৃত্যুসংবাদ তাঁহার বিচ্ছেদকে উদ্বেগে পরিণত করিল। তিনি আকুল হইয়া বলিলেন, ‘আমার যে মাতাকে বরণ করিবার কথা—তাঁহাকে ভয় না করিয়া যাইব কোথায়?’

এই উদ্বেগের উত্তরেই তাঁহার অদৃষ্ট জননী (আর দৃষ্ট সহধর্মিণী) ইয়োকাস্তে কহিয়াছিলেন, ‘যেখানে জীবন কেবল অদৃষ্টের উপর ভর করিয়া চলে, যেখানে ভবিতব্যে কি আছে তাহার কোন নিশ্চয় নাই—সেখানে যাহার যতটা সাধ্য ততটা জীবনযাপনই কি একমাত্র পথ নহে? তোমার মাতৃদেবীকে বরণ করিতে হইবে এই ভয় করিও না। স্বপ্নে যাহারা যাহারা মায়ের সহিত শয়ন করিয়াছে এমন লোকের সংখ্যা তো কম নহে। এই সকল বিষয় যাহাদের কাছে পাত্তাই পায় না তাহারাই জীবনযাপন উত্তম করেন।’

শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সত্যসত্যই রাষ্ট্রপতি ইদিপাসের ভয়ের কারণ নাই। তাঁহার অদৃষ্ট এতদিনে আর ভবিতব্যের গর্ভে নিহিত নাই। তাঁহার অদৃষ্ট অতীতের গর্ভে চলিয়া গিয়াছে। তাহা হইতে পলাইবার দেশ নাই। নিয়তি শব্দের অর্থ যাহার ‘য়তি’ (বাংলায় ‘যতি’) নাই।

পরিশেষে যখন স্পষ্ট হইল—অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি ইদিপাস অদৃষ্টের দেখা পাইলেন—তখন সেই স্পষ্টতা তৎক্ষণাৎ অন্ধকারে পর্যবসিত হইল। তিনি নিজেই নিজের দুইটি চোখ খুলিয়া দিলেন। আমাদের দেশের কোন কোন পত্রিকা দাবি করেন তাহারা পাঠকের চোখ খুলিয়া দেন, রাষ্ট্রপতি ইদিপাসের এই চোখ খুলিয়া দেওয়ার ঘটনাটা তাহার সহিত তুলনীয়।

অন্ধ ইদিপাসের মুখোমুখি দাঁড়াইয়া কোরাস তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আমি জানি না, আপনি কাজটি ভালো করিলেন কিনা—এই অন্ধ অবস্থায় জীবনধারণের চাহিতে আপনার মরিয়া যাওয়াটাই কি ভালো ছিল না?’ উত্তরে ইদিপাস যাহা বলিয়াছিলেন তাহাতে জাক লাকাঁর প্রতিধ্বনি শোনা যায়। ইদিপাস কহিলেন: ‘যাহা করিয়াছি তাহা ভালো করি নাই—এই উপদেশ আমাকে দিবার দরকার নাই। অধিক উপদেশ দিয়ো না। কারণ আমি জানি না যখন মৃত্যুপুরীতে গিয়া হাজির হইব তখন এই চোখ লইয়া আমি কি করিয়া আমার বাপজানের মুখোমুখি দাঁড়াইব? কিংবা কি করিয়া দাঁড়াইব আমার আম্মাজানের সম্মুখে? তাঁহাদের দুইজনের বিরুদ্ধেই আমি এমন সব কর্ম করিয়াছি ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিলেও যাহার যথাযথ প্রায়শ্চিত্ত হইবে না।’

কর্তার বিভক্তি যে কর্মেও বিভক্তির কাজ সম্পন্ন করে—ফলে দৃষ্টির অগোচর বা অদৃষ্টের সৃষ্টি হয় তাহা সোফোক্লেস ভালোভাবেই আমল করিয়াছিলেন। সাহিত্যের কথা ছাড়িয়া দিন—সিনেমার একমাত্র মূলধন এই অদৃষ্টের তাড়া। এই তাড়না না থাকিলে জগতের সিনেমা ব্যবসায়ে ধ্বস নামিত।

 

 

দোহাই

 

১. দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মজীবনী, সতীশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত, তৃতীয় সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ (কলিকাতা: বিশ্বভারতী, ১৯৬২)।

২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গীতবিতান, অখণ্ড সংস্করণ, পুনর্মুদ্রণ (কলিকাতা: বিশ্বভারতী, ১৪০৪)।

৩. Jacques Lacan, ‘Le Seminaire Livre I, Les écrits techniques de Freud, 1953-54,’ ed. Jacques-Alain Miller (Paris: Éditions du Seuil, 1975).

৪. Jacques Lacan, ‘Le Seminaire Livre XI, Les quatre concepts fondamentaux de la psychanalyse,’ ed. Jacques-Alain Miller (Paris: Éditions du Seuil, 1973).

৫. Jean-Paul Sartre, Being and Nothingness: An Essay on Phenomenological Ontology, trans. Hazel E. Barnes (London: Methuen, 1958).

৬. Maurice Merleau-Ponty, The Visible and the Invisible, ed. Claude Lefort, trans. Alphonso Lingis (Evanston: Northwestern University Press, 1968).

৭. Charles Baudelaire, The Complete Verse, vol. I, ed. and trans. Francis Scarfe (London: Anvil Press, 1986).

৮. Sophocles, Ajax. Electra. Oedipus Tyrannus, ed. and trans. Hugh Lloyd-Jones, reprinted (Cambridge, Mass: Harvard University Press, 1997).

 

লেখক পরিচিতি: চিন্তাবিদ ও শিক্ষক। আমি তুমি সে, স্বাধীনতা ব্যবসায়, আদমবোমা, প্রার্থনা প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

(লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০২০ সালে সিনেমা দর্শন পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়)