কলকাতার বাঙালি মুসলমান ও সাহিত্য সংস্কৃতির জগৎ

শুভ বসু প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২২, ০৩:৫৪ পিএম কলকাতার বাঙালি মুসলমান ও সাহিত্য সংস্কৃতির জগৎ

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার পুনর্জাগরণ এবং তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে গুরত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে।

এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ঊনবিংশ শতাব্দীর যাঁরা কলকাতার গণবুদ্ধিজীবী ছিলেন তাঁদের অনেকেই একটি উদ্ভিন্ন মধ্যবিত্ত সমাজ থেকে এসেছিলেন এবং তাঁরা বহুবিষয়ে ঔপনিবেশিক চিন্তাকে গ্রহণ করেছিলেন এবং বহু বিষয়ে সেই ডিসকোর্সের সমালোচনা করেছিলেন। এটি সামগ্রিক অর্থে মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দুর নতুন জীবন জিজ্ঞাসার পরিচায়ক। এখানে তাঁরা গ্রামবাংলার লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। এমন কি লালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক এবং লোক সংগীতকার তাঁদের দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তাদের অনেকের মধ্যে গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতি এবং লোকজ মুসলমান সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা ছিল। যদিও এঁদের অনেকেরই ফার্সি ভাষায় অসাধারণ বুৎপত্তি ছিল। তবে তাঁরা মুসলমান বলতে ফার্সি শিক্ষিত আশরাফ মানুষের কথা চিন্তা করতেন।

আবার বাংলার পণ্ডিত মুসলমান চিন্তক যেমন হুগলির সৈয়দ আমির আলী সাহেব বা ফরিদপুরের নবাব আব্দুল লতিফ সাহেব কিন্তু উর্দুভাষায় এবং ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা চর্চায় গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষায় যে সাহিত্যচর্চা ছিল যেমন মুন্সী রেজাউল্লার কাসাসুল আম্বিয়ার বা নবীগণের জীবনী বা আনিসুজ্জামান সাহেবের দাদা আব্দুর রহিম সাহেব ১৮৯৪ সালে মিহির ও সুধাকর বলে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এছাড়া স্বনামধন্য মীর মশাররফ হোসেন তো রয়েছেন। মীর মশাররফ হোসেন বাঙালি সাহিত্যের জগতে এক রেনেসাঁস ব্যক্তিত্ব। তিনি সবর্প্রথম ঘোষণা করেন- 

"বঙ্গবাসী মুসলমানদের দেশভাষা বা মাতৃভাষা “বাঙ্গালা”। মাতৃভাষায় যাহার আস্থা নাই, সে মানুষ নহে। বিশেষ সাংসারিক কাজকর্ম্মে মাতৃভাষারই সম্পূর্ণ অধিকার। মাতৃভাষায় অবহেলা করিয়া অন্য দুই ভাষায় বিখ্যাত পণ্ডিত হইলেও তাহার প্রতিপত্তি নাই। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এমনকি প্রাণের প্রাণ যে স্ত্রী, তাহার নিকটেও আদর নাই। অসুবিধাও বিস্তর। ইস্তক ঘরকন্নার কার্য্য নাগাদে রাজসংশ্রবী যাবতীয় কার্য্যে বঙ্গবাসী মুসলমানদের বাঙ্গালা ভাষার প্রয়োজন।"

বিংশ শতাব্দীতে বাংলাভাষায় মুসলমান সাহিত্য জগৎ বিরাটভাবে তৈরি হয়। কলকাতায় আল-এসলাম , সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র হয়। আবু হোসেন সিরাজী তাঁর প্রখ্যাত ভ্রমণকাহিনী 'তুরস্ক ভ্রমণ' রচনা করেন। সেই সময় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির দপ্তরের সচিব এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সহ-সম্পাদক ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা মুজাফ্ফর আহমদ। কায়কোবাদ, এমদাদ আলী , আবু হোসেন সিরাজী প্রমুখ সাহিত্য পত্রিকা অফিসে আড্ডা জমাতেন।

কলকাতার সাহিত্য পত্রিকার আড্ডার মধ্যমনি ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। আবুল কালাম শামসুদ্দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, মোসলেম ভারতের আফজালুল হক সাহিত্য সমিতির একটা কামরায় থাকতেন। নজরুল ইসলাম সেখানে ঢুকলেন। সে ঘরেই বসত নরক গুলজার করা আড্ডা। কাজী আব্দুল ওদুদ, আফজালুল হক, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, করুণানিধান বন্দোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় এরা সবাই মুসলিম সাহিত্য সমিতির ঘরে বসে আড্ডা দিতেন। আর সেই সঙ্গে থাকতেন আবুল কালাম শামসুদ্দিন আর কখনো কখনো আবুল মনসুর আহমদ।

সেই সময়ের এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো: বাংলা ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার প্রয়াস। শান্তিনিকেতনে ১৯১৮ সালে জ্ঞান তাপস শহীদুল্লা শান্তিনিকেতনে আম্রকুঞ্জে একটি সভায় একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন যে বাংলা ভাষা ভারতের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হতে পারে কিনা। সভায় ডক্টর তারাপুরওয়ালা বলেন যে ভারতে হিন্দি ছাড়া আর কোনো ভাষার সে সম্ভবনা নেই। সভায় উপস্থিত বিধুশেখর শাস্ত্রী কোনো মত দেন নি। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সভার সভাপতি। সেই থেকেই শহীদুল্লা সাহেব বাংলার পক্ষে দাঁড়ান। শহীদুল্লা সাহেব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত স্নাতক উর্ধস্তরে পড়ার সময়, এক ব্রাহ্মণ পন্ডিত ম্লেচ্ছ শহীদুল্লা সাহেবকে বেদ ভাষা অধ্যয়ন করাবেন না বলে জেদ ধরেন । তখন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে কম্পারেটিভ ফিলোলোজি বলে একটি বিভাগ খুলে পড়ার ব্যবস্থা করে দেন। শহীদুল্লা সাহেব হলেন প্রথম ভারতীয় মুসলমান যিনি Sorbonne university থেকে ভাষাতত্ত্বে ডক্টরেটে করেন। এবং তিনি প্রমাণ করে দেখান যে বাংলা ভাষার উৎপত্তি মাগধী অপভ্রংশ থেকে। ১৩ ই জুলাই ১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে একটি চিঠিতে লেখেন:

"বাংলার ভাষাতত্ত্ববিচার সম্বন্ধে আপনার যোগ্যতার প্রশংসা অনাবশ্যক। এ প্রসঙ্গে আপনি যে আমাকে সাধুবাদ দিয়েছেন তাতে আমি সংকোচ বোধ করি। যে সময়ে আমি এই অনুশীলনে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম তখন এ পথে আমি ছিলাম একা। তা ছাড়া বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে আমি সম্পূর্ণ আনাড়ি। অন্ধকারে আমার প্রদীপ ছিল না , হাতড়িয়ে বেড়িয়েছি। যখন থেকে আপনার হাতে আলো জ্বললো , তখন থেকেই এই অধ্যাবসায় ত্যাগ করেছি।"

আমার কখনো কখনো মনে হয়, আমরা পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা আত্মবিস্মৃত জাতি। তাই এই ইতিহাস আমাদের অনেকের অবহিত নেই। এখনো সেই জন্যে প্রশ্ন করি আচ্ছা 'উনি বাঙালি না মুসলমান' ?