১৯৪৭ থেকে ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলনের পরিচয় দিতে লোকে মধ্যবিত্ত ছাত্র এবং লেখকদের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির উপর চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্র ভাষার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা বলেন। ব্যতিক্রমী ঐতিহাসিক বদরুদ্দীন উমর। যিনি ভাষা আন্দোলনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন এই আন্দোলন শ্রমিক-কৃষকের তাঁদের মুখের ভাষা রক্ষার আন্দোলন।
প্রকৃত পক্ষে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২'র পূর্ব বাংলার ইতিহাসের দলিল ঘেটে দেখেছি দেশ বিভাগের ফলে পূর্ব বাংলার ক্রম সম্প্রসারিত কৃষি অর্থনীতি এক ভূমি রাষ্ট্রের সীমানার মধ্যে সংকুচিত হয়ে গেলো। তার ফলে পূর্ববাংলার জনসংখ্যার চাপে এবং চিরস্থায়ী ভূমি ব্যবস্থার চাপে কৃষকরা আসামে এবং ত্রিপুরায় চলে যেতেন তা বন্ধ হয়ে গেলো। তার উপরে ভারত ও পাকিস্তানের মুদ্রার মূল্যমানের অবনয়ন নিয়ে বিতণ্ডার ফলে বন্ধ হয়ে গেলো দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য। সেই সঙ্গে পূর্ববাংলায় ভূমি সংস্কারের ফলে জমিদারি প্রথা নির্মূল হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এমন ভাবে খাজনা কৃষকদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো যে কৃষকদের দারিদ্র বেড়ে গেল। সরকারি আমলাতন্ত্রের হাতে চলে গেল উন্নয়নের প্রশ্ন এবং কৃষি কাজের উপর উন্নয়ন এমনভাবে হলো যে চাষিরা পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিলো জমির জল সেচ এবং খাল কাটা নিজের হাতে নিয়ে।
এছাড়া কমিউনিস্টরা পূর্ববঙ্গের মধ্যে নানা বিদ্রোহ সংগঠিত করলো, নাচোলের আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহ, গারো পাহাড়ে হলো হাজং বিদ্রোহ আর সিলেটের নানকর বিদ্রোহ। বরিশালেও দেখা দিলো কৃষক আন্দোলন। তরুণ মুসলিম লীগ কর্মী শেখ মুজিব দাওয়াল বা ভ্রাম্যমান কৃষি শ্রমিকদের কাছে গিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন: এই কি পাকিস্তানের স্বরূপ?
জিন্নাহ ফান্ডের টাকা আদায়ের নামে সরকারি আমলারা কৃষকদের গুরু-বাছুর , বদনা-ঘটিবাটি পর্যন্ত কেড়ে নিতে শুরু করেন। কৃষক বিদ্রোহ দমনে সরকার কঠোর ভূমিকা নিলেও পূর্বতন ভূস্বামীদের তাদের ধনদৌলত নিয়ে ভারতে পালিয়ে আসতে দিলেন মুসলিম লীগ সরকার। পুঁজির পলায়ন হলো পূর্ব বাংলা থেকে। খাদ্য সংকট এতো তীব্র হলো যে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি দাঁড়িয়ে গেলো পূর্ববঙ্গে। শাশ্বত ঈদের রাজত্ব আসবে বলে যে পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন কৃষকরা তাঁদের কবরেই রচিত হয়ে গেলো মুসলিম লীগের সমাধি।
১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয় ভয়ঙ্কর দাঙ্গা। মজার বিষয় হলো দাঙ্গার মধ্যেও পূর্ববঙ্গের উজিরে আলা নুরুল আমিন সাহেব পশ্চিমবঙ্গে প্রতি ১৫ দিন চিকিৎসার জন্যে আসতেন ডাক্তার বিধান রায়ের কাছে। দুই বাংলার রাজনৈতিক নেতারা যখন কমনওয়েলথ ডোমিনিওন মিটিং করতেন তখন তাদের রঙ্গ রসিকতা দেখে বোঝার উপায় ছিলোনা যে তাঁরা পরস্পরকে জনসমক্ষে সমালোচনা করেন। নুরুল আমিন ঠাট্টা করতেন দার্জিলিঙে 'নাজিমুদ্দির বাড়িটা কাইড়া ন্যান ক্যান ডাক্তার সাহেব!' কিন্তু বাংলার হাজার হাজার দলিত এবং মুসলমান কৃষক গৃহহীন হয়ে যাচ্ছেন তার প্রতি কোনো দৃষ্টি ছিল না তাদের। বরং কর্ডন করে চালের গতিপথ রুদ্ধ করে তাদের খাদ্য সংকট আরো বাড়িয়ে তুলেছিলেন তাঁরা।
পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীরা তখন বাংলা ভাষা সংস্কারে ব্যস্ত। কবি গোলাম মোস্তফা যিনি অতীতে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের 'আমার মাথা নত করে দাও' গানটির মধ্যে ইসলামের মর্মবাণী নিহিত রয়েছে, তিনি তখন কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার হিন্দুভাবনা সংস্কার করতে ব্যস্ত পাকিস্তানের উপযোগী করতে। কবি ইকবাল কেন নজরুলের চেয়ে পাকিস্তানের উপযোগী, কবি মোস্তফা তাই প্রমাণ করতে চাইতেন। তিনিই "সকালে উঠে মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি" এই ছড়াটিকে ভাষান্তরিত করেন: "ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি/ তামাম রোজ আমি যেন নেক হয়ে চলি।"
প্রকৃত পক্ষে নাজিমুদ্দিন সাহেব যখন 'মুখের জবান কাইড়া নিতে যান ' তখন বাংলার শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র আন্দোলন করে বাংলার মুখের ভাষা রক্ষা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সময়ে বিহারের মানভূম জেলায় ভাষা আন্দোলন হয়। সেই জেলার কৃষি-শ্রমিক এবং মহিলারাই বাংলাভাষার জন্যে আন্দোলন করে পুরুলিয়া জেলা হিসাবে তা বাংলার সঙ্গে যুক্ত করেন । বাংলার শ্রমিক কৃষকই বাংলাভাষা তাঁদের মুখের ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই ভাষা 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা'র কাহারদের ভাষা , তিতাস নদীর জেলে মালোদের ভাষা , 'খোয়াবনামা'র বিলের জেলেদের ভাষা , তেভাগার কৃষকদের ভাষা । তাই ভাষা আন্দোলনের দিনে আমার প্রিয় গান হলো সেই গণ সংগীত:
রবি ঠাকুর হে একবার আইস ক্যানে মোদের গাঁয়ে তে
ভোরের আজান হইয়া আইস মোদের গাঁয়েতে
আর সেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের মার্ক্সবাদী ভাষ্যকার বদরুদ্দীন উমরের ইতিহাস রচনা দীর্ঘজীবী হোক।
শ্রমিক কৃষক ঐক্য জিন্দাবাদ
আন্তর্জাতিক মাতৃ ভাষা দিবস জিন্দাবাদ