বেনারসের ঘাট থেকে ক্যামেরা ঢুকে পড়ে গলিতে। এরপর রক্তের শিরার মতো বিস্তৃত গলিপথ ধরে আমরা পৌঁছে যাই ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁয়ের বাড়ি। সামনে উঠান। রোদ আছড়ে পড়েছে। যেন বিসমিল্লাহ খাঁয়ের সানাই শুনতে এই প্রণতি। কথার যাদু। সুরের টান। মোহগ্রস্ত না হয়ে উপায় কি! গৌতম ঘোষের প্রামাণ্যচিত্র ‘সাঙ্গে মিলসে মোলাকাত’ (১৯৮৯) দেখছিলাম। মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ার মতো কথা বলেন ওস্তাদ, আর বাদনে তো লা-জবাব। বিশ্বখ্যাত সানাই বাদকের সঙ্গীত নিয়ে বলার মতো এলেম আমার নেই। তাই শুধু উনার জীবনবোধ উদ্ধৃত করতে চাই।
প্রশ্নকর্তার বেমক্কা প্রশ্ন, ধর্মে তো গানবাজনা নাজায়েজ, হারাম। তো ওস্তাদ আপনি কেন সঙ্গীতচর্চায় এলেন? ওস্তাদ উত্তরে বললেন, দেখুন রাস্তার ধারে যে পানবিড়ির দোকান দেয়, সেও একটা সময় বড় দোকানের মালিক হয়, তার ব্যবসা বড় হয়। টাকাকড়ি হয়। আর সঙ্গীতসাধক বছরের পর বছর সে সাধনা করে। টাকাকড়ির দেখা মেলে না। উল্টো সে যত সঙ্গীতের সাগরে প্রবেশ করতে থাকে, সে ডুবে যায়, সংসার কি, সন্তান কি! সকলের প্রতি উদাসীন হয়ে যায়। সমাজ তো তাকে হারাম বলবেই। কিন্তু সঙ্গীত-সূধার স্পর্শ যে একবার জিহ্বায় পেয়েছে সে চন্দ্রগ্রস্ত হয়। বিসমিল্লাহ খাঁয়েরও তাই হয়েছিল। শৈশব থেকে তিনি তালিম নিয়েছেন মামা, ওস্তাদ আলি বকস খাঁয়ের কাছ থেকে। কৈশোরেই পেয়েছেন সাফল্য। এরপর নিজেকে ভাসিয়ে দেন সুরের সায়রে। অর্থের মোহ তাকে টলাতে পারেনি।
রাজদরবার থেকে সাধারণের মাঝে রাগসঙ্গীতের চর্চা নিয়েও কথা বলেন বিসমিল্লাহ খাঁ। নিজের কৈশোর ও যৌবনে বহু সাধারণ মানুষের মাঝে বাজিয়েছেন তার সুরযন্ত্র। আশীর্বাদ পেয়েছেন, প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সানাই দিয়ে জয় করেছেন বিদেশের মাটিকেও। তিনি রাগসঙ্গীতকে বেঁধে রাখেননি, বরং ছড়িয়ে দিয়েছেন সামান্যে। বার্ধক্যেও তিনি মহররমের সময় গলিতে দাঁড়িয়ে মরমী সুর তোলেন সানাইতে। মহল্লার সকলে শুনে আপ্লুত হয়।
বলতেই হবে বড্ড দরদ দিয়ে এই সিনেমা বেঁধেছেন গৌতম ঘোষ। সম্প্রতি তিনি ৭৩ পূরণ করলেন, ১৯৫০ সালের ২৪ জুলাই তার জন্ম। সেই উপলক্ষ্যে ওটিটি প্লাটফর্ম মুবি আয়োজন করেছে এক রেট্রোস্পেকটিভের, অর্থাৎ পেছনে ফিরে দেখা। সেই আয়োজনে আরো দুটি ছবি স্থান পেয়েছে। একটি হলো ‘পার’ (১৯৮৪), অন্যটি ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ (১৯৮৭)।
সমরেশ বসুর গল্প অবলম্বনে নির্মিত ‘পার’ ছবিতে দুটি সংগ্রামের চিত্র পাওয়া যায়। বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জমিদারের শোষণের জবাব দিতে গিয়ে জমিদার-ভ্রাতাকে হত্যা করে ফেলে দরিদ্র গ্রামবাসী। এরপর তাদের উপর নেমে আসে অত্যাচার। খুন-জখম-আগুন। নিম্নবর্গের সেই মানুষগুলো তখন জীবন বাঁচাতে মরিয়া। গ্রাম থেকে পালাতে বাধ্য হয় নওরঙ্গিয়া (নাসিরউদ্দিন শাহ) ও রমা (শাবানা আজমি)। গ্রামে সামন্তবাদের সাথে লড়াই করে, কিঞ্চিত বিজয় নিয়ে তারা যখন কলকাতার মতো পুঁজিবাদী শহরে এসে উপস্থিত হয়, তখন শুরু জীবনের আরেক সংগ্রাম। কোথাও কর্ম খালি নেই। শেষ পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে গঙ্গার এপার থেকে ওপারে শূকরের পাল পৌঁছে দেয়ার কাজ পায়। অর্থ সামান্যই। কিন্তু তারা টিকে থাকতে চায়। বেঁচে থাকতে হবে। যে কোনো উপায়ে। রমার গর্ভে সন্তান। শূকরের পালেও রয়েছে গর্ভবতী পশু। তাকে বাগে আনা সহজ কাজ নয়। কিন্তু অমানসিক পরিশ্রমে, বিশাল নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে এই নারী ও পুরুষ অসম্ভবকে সম্ভব করে। বরাহদের সাঁতরে পার করে দেয় নদী। হাতে টাকা পায়। কিন্তু রাতে খেয়াল করে শিশুটি আর গর্ভে নড়াচড়া করে না। রমা কান্নায় ভেঙে পড়ে। নওরঙ্গিয়া ভালো করে কান পাতে পেটে। একটু পর বলে, না ওদের বাচ্চা চিৎকার করছে। এই ভূমির আদি ও অকৃত্রিম সন্তানেরা শক্তির প্রতিভূ, তারা কোনো কিছুতেই হার মানে না। এতো অত্যাচার ও প্রতিকূলতার ভেতরেও তারা অস্তিত্বের জানান দেয় চিৎকার দিয়ে। নিম্নবর্গের মানুষের শক্তিমত্তার স্বাক্ষর বহন করা ‘পার’কে তাই শেষ পর্যন্ত আমার মনে হয়, এস এম সুলতানের আঁকা কোনো সুঠামদেহী শ্রমজীবীকে ধারণ করা বলিষ্ঠ চিত্রকর্ম।
কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস থেকে তৈরি করা ‘অন্তর্জলী যাত্রা’য় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা মৃত্যুপথযাত্রী কুলীন ব্রাহ্মণের সাথে কম বয়সী মেয়ের বিয়ে দেয় স্বর্গলাভের আশায়। মেয়েটিকে সহমরণে যেতে হবে, কারণ বুড়ো শেষ মুহুর্তের অপেক্ষায়। একদিকে ছেলেরা সম্পত্তির ভাগ নিয়ে মারামারি করছে, অন্যদিকে এক পা চিতায় দিয়ে বুড়ো স্বপ্ন দেখছে নতুন বউয়ের সাথে আরো ক’টা বছর কাটাবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে! শেষ পর্যন্ত জোয়ারের টানে বুড়ো যায়, নববধূও যায়। আর্তনাদ করে শ্মশানের চাঁড়াল বৈজু (শত্রুঘ্ন সিনহা)। এই বৈজুই হলো চলচ্চিত্রের বিবেক। সমাজের অচ্ছুত লোক হিসেবে পরিচিত বৈজুই ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্মান্ধদের স্বরূপ তুলে ধরে দর্শকের সামনে। গৌতম ঘোষ এই ছবিতে একটা চোখ আঁকা নৌকা ব্যবহার করেছেন। ছবির মোটিফ। বারবার এসেছে। ঘাটে বাঁধা ছিল। জোয়ারে সেই বাঁধন আলগা হয়ে মাঝগাঙে চলে যায়। জীবনমৃত্যুর এই তরী ছবিটিকে আলাদা সৌন্দর্য দান করেছে। বৈজুর আর্ত চিৎকার ছুড়ে দিয়েছে প্রশ্ন, সমাজের প্রতি, সুবুদ্ধির উদয় কি হবে না?
এই তিনটি ছবিতেই সাধারণ নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি একটা দরদ লক্ষ্য করা যায়।