“উপন্যাস লেখার জন্য একজন নারীর অবশ্যই নিজের একটি কামরা ও কিছু টাকা থাকতে হবে, কিন্তু এতেও আপনারা দেখবেন সত্যিকার উপন্যাস ও নারীর স্বরূপ সন্ধানের সমস্যা অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে। কোন উপসংহার টানার দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যাচ্ছি কেননা এই দুটি বিষয়, উপন্যাস ও নারী, আমার বিবেচনায় একটি অমীমাংসিত সমস্যা।” কথাগুলো ভার্জিনিয়া উলফের বলা। যারা তার ‘আ রুম অব ওয়ানস ওউন’ বা ‘নিজের একটি কামরা’ পড়েছেন তারা জানেন কোনো মীমাংসায় পৌঁছানোর জন্য উলফ কথাগুলো বলেননি। ঠিক একইভাবে, ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী কোনো সমাধানে পৌঁছুতে বা নারীদের জিতিয়ে দেওয়ার বাসনায় ‘ছাদ’ চলচ্চিত্রটি বানাননি।
নির্মাতা ইন্দ্রাণী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরিবার ও সংসারের প্রতিবন্ধকতার ভেতর একজন কর্মজীবী নারীর উপন্যাস লিখে ওঠার অভিযাত্রাটি তুলে ধরতে চেয়েছেন। ছোট ছোট ঘাত ও প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে একজন নারীর নিজেকে মেলে ধরার প্রয়াসটি অঙ্কিত করেছেন। ছবির মূল চরিত্র মিত্রা (পাওলি দাম), সে একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক, তার স্বামী সঞ্জু (রাহুল ব্যানার্জী) একটি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। যৌথ পরিবারে তাদের বাস। শাশুড়ির সাথে সম্পর্কটি সহজ নয় মিত্রার। তবে কাকা-শ্বশুরের পরিবারের সাথে মিত্রার চিন্তা মেলে। সঞ্জুর কাকাত বোন মুকুলের সাথে মিত্রার বন্ধুত্ব আছে। তারা ছাদে একসাথে সুন্দর সময় কাটায়। আকাশ দেখে, ঘুড়ি ওড়ানো দেখে। কিন্তু একদিন প্রয়োজনের খাতিরে মুকুল ও কাকার পরিবার জলপাইগুড়ি চলে যায়, মিত্রাও একা হয়ে পড়ে।
মিত্রার লেখালেখির চর্চার ইঙ্গিত আমরা পাই ছবির শুরুতেই। তার একটি ছোট গল্প ‘অস্তিত্বের খোঁজে’ বের হয় একটি সাহিত্য পত্রিকায়। সেখান থেকেই মূলত মিত্রার লেখক সত্তার উন্মোচন আমরা দেখি, দেখি মিত্রার নিজেকে আবিষ্কারের অভিযাত্রা। আরো দেখি, স্বামী সঞ্জু সেই লেখক সত্তাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নয়। বরং স্বামীর তরফ থেকে অবহেলা আর অসহযোগিতাই যেন প্রাপ্য হয়ে ওঠে মিত্রার। তবে আকাশে উদিত সূর্যকে তো আর আটকে রাখা যায় না, মিত্রা রায়ের লেখার প্রসাদ সকলেই গ্রহণ করে এবং এক বড় পত্রিকার পূজা সংখ্যায় উপন্যাস লেখার প্রস্তাব পায়। ঠিক এখান থেকেই চলচ্চিত্রটি প্রবেশ করে নারী ও স্থানের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কে।
পরিচালক দেখাতে থাকেন নারী যতটা মুক্ত ছাদের উপরে, ঠিক ততোটাই অবরুদ্ধ ছাদের নিচে। সেটা হোক শ্বশুরবাড়ি, বা সেটা হোক নিজের বাপের বাড়ি। শ্বশুরবাড়িতে ছাদে ওঠার দরজাটি যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন মিত্রা ম্রিয়মান বিষণ্ণ বিকেল যেন। মন ভালো করতে সকালে ঘুরতে বের হয় মিত্রা, তারপরও সে যেন বিকেলের ঝরে পড়া ফুলের মতো মলিন। ভাগ্যিস একদিন কাকা শ্বশুর জলপাইগুড়ি থেকে এসে মিত্রাকে লেখালেখির জন্য তাদের উপরের তলার একটি কামরা দিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, ছাদটি ব্যবহারের অনুমতিও দিয়ে যান। তখন মিত্রার উপন্যাসের পালে হাওয়া লাগে। ছাদে উঠে আলোবাতাস পেয়ে যেন মিত্রার চিন্তাবৃক্ষ পুষ্ট হতে থাকে। যদিও মায়ের বাড়িতে সে গিয়ে দেখে ছাদটি ঢেকে দেয়া হয়েছে ছাউনি দিয়ে। ভেতরে ভেতরে কিছুটা অবসাদ ভর করে মিত্রার। সে আকাশ দেখার চেষ্টা করে। ছাউনি ভেদ করে পূর্ণিমার আলো পেতে চায়। পূর্ণ মুক্তি যেন বহুদূর! বহুবার সে সঞ্জুকে বলেছে খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে আসার কথা, কিন্তু সঞ্জু বড্ড একঘেয়ে, নিত্যদিনের রুটিনে বাঁধা, মায়ের একান্ত বাধ্যগত সন্তান। স্ত্রীর প্রতি প্রেম বা নজর কোনোটাই নেই সঞ্জুর। নিঃসঙ্গ মিত্রার তাই অবলম্বন হয়ে ওঠে লেখালেখি। সে একটি উপন্যাস লিখে শেষ করতে চায়।
কলকাতা ছেড়ে যাওয়ার আগে ননদ মুকুল বলেছিল, মিত্রার গল্পের নারী চরিত্রগুলোকে যেন মিত্রা জিতিয়ে দেয়। কিন্তু মিত্রা ভালো করেই জানে এখানে হারজিতের কোনো ব্যাপার নেই। ভার্জিনিয়া উলফের মতো কোনো মীমাংসায় পৌঁছুতে চায় না মিত্রা। সে শুধু চায়, নিজের মতো করে জীবন যাপন, অন্যের শর্তে নয়, সমাজের শৃঙ্খলে নয়। আপন আনন্দে, নিজস্ব ছন্দে। সেজন্যই মিত্রা উপন্যাসের চরিত্রের নাম রাখে সুনন্দা। উপন্যাসের শেষটা রচনা করতে কিছুটা বেগ পেতে হয় মিত্রার। কিন্তু যখন সে জানতে পারে, পাশের বাড়ির ছোট্ট ছেলেটা তাদের ছাদে আসে শুধু ঘুড়ি ওড়াতে নয়, সৎ মায়ের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে, তখন যেন বিদ্যুৎ চমকের মতো গন্তব্যের দিশা পায় মিত্রা। সে লিখে ওঠে শেষ অধ্যায়। আমরাও বুঝতে পারি চলচ্চিত্রের শেষ অঙ্কে পৌঁছে গেছি আমরা।
মিত্রার উপন্যাস ছেপে বেরোয় পুজো বার্ষিকীতে, শুধু তাই নয়, সঙ্গে আসে সম্মানী। কেবল সৃজনশীলতার মুক্তিই নয়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতারও ইঙ্গিত রেখে যান নির্মাতা এখানে। এ কারণেই কি টিউব লাইটের নেভা-জ্বলার ভেতর ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে সঞ্জু? স্ত্রীর উপর কতৃর্ত্ব হারানোর শঙ্কা? অবদমিত মিত্রার মুক্তি ঘটেছে উপন্যাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে, সে নিজেকে মেলে ধরেছে তার লেখায়। তাতেই কি স্বামীর চিন্তায় অস্থিরতা পরিলক্ষিত হয়? যেন প্রচণ্ড ঝড় চলছে সঞ্জুর ভেতর, কিছুটা ভীত সে। স্ত্রী তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, সঞ্জু নিজেও লেখালেখি করে, সে বুঝতে পারে স্ত্রীর প্রতিভা, একারণেই কি প্রজ্জ্বলিত অহম অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে সজল মিত্র ওরফে সঞ্জুর? বড় পত্রিকায় লেখা প্রকাশ নিয়ে মিত্রার ভেতর যেমন আত্মবিশ্বাসের ছাপ দেখা যায়, অপরদিকে উপন্যাস পাঠপূর্বক বাইরে বারান্দায় বেরিয়ে এসে, বিগড়ে যাওয়া বাতির সামনে সঞ্জুর সিগারেট ধরানোতে মনে হয়—ফাটল ধরেছে পুং-অহংকারের দালানে। এখানেই শেষ হয় ‘ছাদ’।
আদতে এই ছবি দুটি পথ ধরে এগিয়েছে, প্রথমত স্থান ও কালের নিরিখে নারীর আপন অস্তিত্বের সন্ধান এবং দ্বিতীয়ত নারীর ইচ্ছার স্বাধীনতা, কাজের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ ও অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা। সমান্তরাল এই দুটি বিষয়কেই খুব সতর্কভাবে তীরে পৌঁছে দিতে পেরেছেন ইন্দ্রাণী। উপন্যাসের সুনন্দার মতো মিত্রাও শেষতক একটি জায়গা করে নিতে পারে। সে ভেতরে ভেতরে লেখকই হতে চেয়েছিল। তবে এই দুনিয়ায় কেউ জায়গা ছেড়ে দেয় না, নিজেকেই করে নিতে হয়। ছবির বক্তব্যের মতোই, ছবির ভেতর ছোটখাট কিছু বিষয়কে যেভাবে ইন্দ্রাণী তুলে ধরেছেন তা অপূর্ব। যেমন যখন মুকুল কলকাতার বাড়িটি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই শব্দের মন্তাজ তৈরি করে দর্শককে শোনানো হয় কবুতরের উড়ে যাওয়ার শব্দ। শব্দের প্রতি মনোযোগের আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যায়: সঞ্জু যখন মিত্রার লেখা উপন্যাস পড়া শেষ করে, তখন পেছনে ঘন্টার ধ্বনি শুনি, এর মানে কি পুরুষের মিথ্যা অহমের বিদায়ঘন্টা? ছবিটির সিনেমাটোগ্রাফিতেও দেখা যায় চিন্তার ছাপ। শাশুড়ি ও বউমায়ের কথোপকথনের সময় শাশুড়ির দিকে ক্যামেরা তাক করা হয় নিচ থেকে, আর বউমার দিকে ক্যামেরা তাকায় উপর থেকে। অর্থাৎ কর্তৃত্বের সম্পর্ককে ইন্দ্রাণী এখানে চমৎকার করে অনুবাদ করেন সিনেমার ভাষায়। আর শেষ দৃশ্যে ভাবনার উথালপাথাল পরিস্থিতি বোঝাতে বাতির জ্বলানেভার কথা তো আগেই উল্লেখ করেছি। এমনি প্রতিটি ফ্রেমে যত্ন, সচেতনতা ও বৌদ্ধিক অভিগমন আমাদের বিমোহিত করে।
এই ‘ছাদ’ যেন শুধু ইট-সুরকির ছাদ নয়, কাঁচের ছাদও বটে, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘গ্লাস সিলিং’। মেয়েদের স্বাধীনতা আছে বলা হয়, কিন্তু বাস্তবে? স্বামী সঞ্জু যখন ‘ই’ প্রত্যয় যোগ করে মিত্রাকে বলে, ভালোই লিখেছো, তখন বোঝা যায় কাঁচের ছাদ কাকে বলে। এই চলচ্চিত্র তাই কাঁচের ছাদ ভেদ করে সত্যিকারের পূর্ণিমা দেখার গল্পও বটে। ‘ছাদ’কে যদি নারীর মনস্তত্বকে নতুন ভঙ্গিতে পাঠের আমন্ত্রণ বলি, তাতেও বাড়িয়ে বলা হয় না বলে আমার বিশ্বাস।
দোহাই
ভার্জিনিয়া উলফ, নিজের একটি কামরা, আলম খোরশেদ অনূদিত, (ঢাকা: সংহতি, ২০১৯)
(চলচ্চিত্রটি ২১তম ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখার সুযোগ হয় ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে।)