মান্টো

দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতায় বিপর্যস্ত লেখক     

ফরিদুর রহমান প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২২, ১২:০৮ পিএম দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িকতায় বিপর্যস্ত লেখক     

গল্পকার ও চিত্রনাট্য রচয়িতা সাদাত হাসান মান্টোর জন্ম শতবর্ষে খ্যাতিমান অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্র পরিচালক নন্দিতা দাস তাঁর দ্বিতীয় ছবি ‘মান্টো’র কাজ শুরু করেছিলেন। মান্টো মুক্তি লাভ করেছে ছয় বছর পরে ২০১৮ সালে। অবশ্য মান্টোর সাথে নন্দিতার বসবাস দীর্ঘদিন আগে থেকে। মান্টোকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়াও নিজের লেখা ‘মান্টো এ্যান্ড আই’ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, শুধু সৃজনশীলতা নয়, আমার সংবেদনশীল, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার কথাও বইতে লিখেছি। ‘মান্টো’ প্রচলিত অর্থে কোনো ‘বায়ো পিক’ অথবা জীবন ও কর্মের আলোকে নির্মিত প্রামাণ্য বা কাহিনীচিত্র কোনোটিই নয়। বস্তুত সাদাত হাসান মান্টোর জীবনের সবচেয়ে বড় সংকট কালের এই আখ্যান, সাম্প্রদায়িকতা, ভারত ভাগের কারণে দেশত্যাগ, আর্থিক টানাপোড়েন ও বিচ্ছিন্নতাবোধ এবং সবশেষে অকাল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটি অসামান্য প্রতিভার সান্ত¡নাহীন সমাপ্তির গল্প।   

চল্লিশ দশকের ভারত বর্ষের সামাজিক-রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ও অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে মান্টো ছিলেন ঋজু ব্যক্তিত্বের এক বিদ্রোহী তরুণ। পুরুষ শাসিত সমাজে নারী অবস্থান, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং ক্ষমতাবানদের যে কোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে মান্টো প্রতিবাদী, বলা যায় বিস্ফোরণোম্মুখ। সমাজের এইসব অসহনীয় অসঙ্গতি এবং দেশ বিভাগের বেদনা তাঁকে যে সকল গল্প লিখতে বাধ্য করেছে সেই সব গল্পের কয়েকটি, বিশেষ করে দশ রুপাইয়া, খোল দো, ঠাণ্ডা গোশত কিংবা টোবাটেক সিং এই চলচ্চিত্রে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। 

নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নান্দনিক বিন্যাস সম্ভবত এর সম্পাদনা অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে চিত্রনাট্যের অসাধারণ সৃজনশীল গাঁথুনি মধ্যে নিহিত। সাদত হাসানের স্বল্প পরিসর জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল ও সংকটাপন্ন মুহূর্তগুলোর সাথে লেখকের অভিজ্ঞতা সঞ্জাত কয়েকটি গল্পের অনায়াস আসা যাওয়ায় চলচ্চিত্র ভাষার সার্থক প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। ছবিতে একদিকে মান্টোর জীবনের অনুচ্চারিত শব্দহীন গল্প আর অন্যদিকে লেখক মান্টো তাঁর রচিত গল্পে যে জীবনকে তুলে এনেছেন সেই উচ্চকিত কাহিনী পাশাপাশি চলতে থাকে। দৃশ্যের ভেতরে প্রবহমান দুটি ভিন্ন স্রোতধারা কখন পরস্পরের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় তা বুঝে ওঠার আগেই দৃশ্যান্তর ঘটে এবং দর্শক এক নতুন বাস্তবতার মধ্যে প্রবেশ করেন।

অনেকটা ঋত্বিক ঘটকের মতোই ভারত বিভাগকে কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারেননি মান্টো। শর্তহীনভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষটির ‘মুসলমান’ পরিচয় যখন অনেকের কাছে মূখ্য হয়ে ওঠে তখন আকস্মিকভাবেই দেশ ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মান্টো। তবে বোম্বে যে তাঁর অস্তিত্বের কতটা জুড়ে ছিল তার উদাহরণ ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দৃশ্যে ও সংলাপে। বোম্বের এক পানওয়ালার পাওনা এক টাকা পরিশোধ না করেই চিরদিনের জন্যে পাকিস্তানে চলে যাবার আগে বলেছেন, ‘বোম্বের কাছে চির জীবনের ঋণ রেখে যাচ্ছি।’ সত্যিই তো যে মাটিতে মা বাবা এবং এক সন্তানের কবর, সেই প্রিয় শহর এবং নিজের দেশ ছেড়ে যাবার বেদনা যে কতোটা দুঃসহ তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন।  

শক্তিমান অভিনেতা নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকী এখানে ব্যক্তি নওয়াজ থেকে বেরিয়ে এসে পুরোপুরি মান্টো হয়ে উঠেছেন। মান্টোর চেহারা এবং ব্যক্তিত্বের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ মনে করে ‘মান্টো’ নির্মাণের প্রস্তুতি পর্বেই নন্দিতা দাস তাঁকে মান্টো হিসাবে ভেবে রেখেছিলেন। অভিনেতা পরিচালককে তো বটেই, দর্শকদেরও নিরাশ করেননি। মাঝে মাঝেই মনে হয়েছে সাদাত হাসান মান্টো যেন নিজেই তাঁর জীবনকাহিনী নিয়ে তৈরি একটি প্রামাণ্যচিত্রে মান্টোর ভূমিকায় উপস্থিত হয়ে দর্শকের জন্য বিভ্রম সৃষ্টি করেছেন।

মান্টোর সাথে সাথে বোম্বের সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতে তাঁর সমসাময়িক বেশ কয়েকজন দিকপালের সাথে দর্শকের পরিচয় ঘটে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে যে দুজনের কথা উল্লেখ করতে হয় তাঁদের একজন মান্টোর প্রিয় বন্ধু শ্যাম চাড্ডা আর অন্যজন কথা সাহিত্যিক চলচ্চিত্র নির্মাতা ইসমত চুগতাই। অভিনেতা অশোক কুমার ও সঙ্গীত শিল্পী জদ্দন বাঈয়ের মতো আরো অনেকেই ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসকে ধরে রাখতে উপস্থিত ছিলেন মান্টোকে ঘিরে।  

‘শাবিস্তান’ ছবির শ্যুটিংয়ের সময় ঘোড়া থেকে পড়ে মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে শ্যামের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মান্টো-শ্যামের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব অটুট ছিল। সে কালের জনপ্রিয় এই অভিনেতার লাহোর সফরের অংশটুকু বাদ দিলে চলচ্চিত্রে মান্টোর চিন্তায় বারবার টুকরো টুকরো দৃশ্যে ফিরে এসেছে শ্যামের উপস্থিতি। ১৯৫১ সালে শ্যাম চাড্ডার অসময়োচিত মৃত্যুও মান্টোর জন্যে বড় একটি আঘাত।

অন্যদিকে ইসমত চুগতাই এবং সাদাত হাসান মান্টোর বন্ধুত্ব ছিল হাসি ঠাট্টার পাশাপাশি লেখার জগতে পরস্পরকে সহযোগিতা ও সমালোচনার। প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে দুজনেই চারপাশের বাস্তবতাকে বহুগুণ বর্ধিত করে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। মানুষ হিসাবে দুজনেই ছিলেন মুক্তচিন্তার অধিকারী, সাহিত্যে অশ্লীতার দায়ে অভিযুক্ত হতে হয়েছে দুজনকেই এবং বিভিন্ন সময়ে দেশে এবং বিদেশে নিষিদ্ধ হয়েছে তাঁদের বই । প্রায় সমবয়সী দুজন নারী পুরুষের এই ঘনিষ্ঠতা স্বাভাবিকভাবেই সমকালীন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তবে দুই লেখকের আত্মীক সম্পর্ক মান্টো-সাফিয়ার দাম্পত্য জীবনে কোনো প্রভাব ফেলেনি, কারণ বাইরের জগতে অসহিষ্ণু উড়নচণ্ডী মান্টো ঘরে ছিলেন প্রকৃতপক্ষেই একজন ঘরোয়া মানুষ। মান্টো শুধু লেখক হিসাবে নারীবাদী ছিলেন না, তাঁর  পারিবারিক জীবনেও এই বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে। সারা জীবন নিদারুণ অর্থকষ্টের সাথে লড়াই করেও সাফিয়া সম্ভবত একবারই গলা চড়িয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার লেখালিখি আমাদের অনাহারে মেরে ফেলবে।’  

ভারত বিভাগের পরে মান্টো বেঁচেছেন মাত্র সাত বছর। স্বামীর আকস্মিক সিদ্ধান্তে পাকিস্তানে এসে উদ্বাস্তু উন্মুল জীবন বেছে নেয়া, সার্বক্ষণিক অর্থ সংকট এবং বান্ধবহীন নিঃসঙ্গতার সাথে, মাঝে মধ্যেই আদালতে হাজিরা সাফিয়ার জন্যেও ছিল উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় পরিপূর্ণ। রক্ষণশীল সমাজের রক্তচক্ষু ও সেন্সরের নামে বিচার বুদ্ধিহীন রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে মন্টোর জীবন যখন বিপর্যস্ত, সে সময় সস্তা মদের নেশায় আকণ্ঠ ডুবে থেকে তিনি নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলেছিলেন। এ সব নিয়ে সাফিয়ার বেদনাবোধ থাকলেও কোনো বিরোধ ছিল না। ব্যক্তিজীবনে সাফিয়া ছিলেন ভীষণ শান্ত ও নরম স্বভাবের, অল্প কথা বলা, প্রায় প্রতিবাদহীন এক চরিত্র।  তবে নন্দিতা তাঁর ছবিতে সাফিয়াকে কিছুটা প্রাণবন্ত করে উপস্থাপন করেছেন।

সাফিয়া চরিত্রে রসিকা দুগাল, শ্যাম চাড্ডা চরিত্রে তাহির ভাসিন এবং ইসমত চুগতাইয়ের ভূমিকায় রাজশ্রী দেশপান্ডের অভিনয় গুণে দর্শক চরিত্রগুলোর সাথে সহজেই একাত্ম হতে পেরেছেন। পাকিস্তানি শিক্ষাবিদের ভূমিকায় জাভেদ আখতার এবং চলচ্চিত্র প্রযোজকের চরিত্রে ঋষি কাপুর তাঁদের স্বল্পকালীন উপস্থিতি দিয়েই সমৃদ্ধ করেছেন ‘মান্টো’কে।

দুই একটি ছোট দৃশ্যে বিভাগোত্তর ভারত-পাকিস্তানে মানুষের মূল্যবোধের বিপর্যয় তুলে এনেছেন নন্দিতা। মহাত্মা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের পরে বাজারে সবজি বিক্রেতা যখন একজন তরুণকে প্রশ্ন করে খুনির পরিচয় জানতে চান, সে ছুটতে ছুটতে উত্তর দেয় ‘একজন হিন্দু তাকে খুন করেছে।’ উত্তর শুনে বিরক্ত বয়োবৃদ্ধ সবজিওয়ালা। তিনি স্বগতোক্তির মতো বলেন, ‘একটা দুঃসংবাদ কীভাবে দিতে হয় তাও এরা জানে না।’ হত্যাকারীকে খুনি হিসাবে চিহ্নিত না করে তাকে ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত করার মধ্যে যে অশ্লীল ধর্মান্ধতা প্রকাশ পায় তার আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিচালক হিসাবে নন্দিতা দাস যে কতটা পরিশীলিত তা এই একটি দৃশ্যেই অনুমান করা যায়। 

কার্তিক বিজয়ের ক্যামেরায় এবং রীতা ঘোষের দৃশ্য পরিকল্পনায় স্বাধীনতা পূর্বকালের বোম্বে এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের লাহোরের বিশ্বস্ত চিত্রায়ণ দর্শককে অতীতের এই শহর দুটিতে সহজেই ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কাহিনীর উত্তাল পটভূমি এবং সামাজিক অস্থিরতার সাথে ব্যক্তি জীবনের দ্ব›দ্ব ও সংকটের তীব্রতার কারণে রঙিন এই চলচ্চিত্রটিকে মাঝে মাঝেই বর্ণহীন বলে মনে হয়। এই বোধ নির্মিতির দিক থেকে ছবিটিকে অবশ্যই উচ্চতার একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছে দেয়। 

মানুষের অসহিষ্ণুতা, ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মন্ধতা, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং রাষ্ট্রীয় ন্যায়নীতিসহ মানবিক মূল্যবোধ যখন পৃথিবী থেকেই নির্বাসিত তখন সাদত হাসান মান্টো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। চিত্রনাট্যে মান্টোর প্রতিবাদী এবং অনেক সময় মর্মভেদী গল্পগুলোর নিখুঁত সন্নিবেশ এবং একই সাথে লেখকের দৃশ্যমান ও অব্যক্ত বেদনার কাহিনী নির্মোহভাবে তুলে আনার নৈপুন্য উপলব্ধির জন্যে নন্দিতা দাসের ‘মান্টো’ একাধিকবার দেখা যেতে পারে।