দ্য সেভেন্থ সিল

মহামারীকালে ঈশ্বরের অনুসন্ধান

ফরিদুর রহমান প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২২, ১১:৫৬ এএম মহামারীকালে ঈশ্বরের অনুসন্ধান

‘দ্য সেভেন্থ সিল’ নির্মাণের বহু বছর পরে ইঙ্গমার বেরিম্যানকে মৃত্যু সম্পর্কে তাঁর ধারণা জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেছিলেন একজন সাংবাদিক। বেরিম্যানের উত্তর ছিল, ‘I was afraid of enormous emptiness. But my personal view is that when we die we die, and we go from one state of something to absolute nothingness. And I don’t believe for a second that there’s anything above and beyond or anything like that, and this makes me enormously secure.’

জীবন ও মৃত্যু, মানুষের অদৃষ্ট এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বের মতো জটিল ও অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো নিঃসন্দেহে বেরিম্যানকে তাঁর মধ্য তিরিশে ভীষণভাবে তাড়িত করেছিল। এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একটি রূপকধর্মী কাহিনীর মধ্য দিয়ে তিনি মহামারীতে বিপর্যস্ত মধ্যযুগের সুইডেনে এক দীর্ঘ পথযাত্রার আয়োজন করেছেন, যেখানে অলৌকিক চরিত্রের রহস্যময় উপস্থিতি এবং নিত্যদিনের কঠিন বাস্তবতা কখনো কখনো দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। 

দশ বছরব্যাপী ধর্মযুদ্ধ থেকে দেশে ফেরার পথে সমুদ্রতটে মৃত্যুর সাথে নাইট আন্তনিয়াস ব্লকের সাক্ষাৎ ঘটে। মৃত্যুকে তিনি দাবা খেলায় আহবান জানান। শর্ত অনুসারে খেলায় হেরে না যাওয়া পর্যন্ত নাইটকে মৃত্যু স্পর্শ করতে পারবে না। জীবনের অনিবার্য পরিণতির আগে ব্লক কতগুলো প্রশ্নের উত্তর পেতে চান এবং সম্পন্ন করতে চান অন্তত একটি ভালো কাজ। দাবার প্রতিটি চালের মধ্যবর্তী সময়ে নাইট তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর জেসহ প্লেগ আক্রান্ত গ্রামাঞ্চলের ভেতর দিয়ে এগোতে থাকেন। পথে বিচিত্র সব চরিত্রের সাথে তাঁর দেখা হয়, যাদের মধ্যে ভবঘুরে অভিনেতা জোফ, তার স্ত্রী মিয়া এবং শিশুপুত্র মাইকেলই কেবল জীবনের প্রতীক। মহামারীর দুর্যোগ উপেক্ষা করে তারা মঞ্চ সাজিয়ে কৌতুকপূর্ণ দৃশ্যে অভিনয় করে, ঘুমভাঙা ভোরের স্বপ্নের মতো মা মেরীর সাথে যিশুর দর্শন লাভ করে জোফ, নাইটের সামনে স্ট্রবেরি এবং দুধের সম্ভার নিয়ে উপস্থিত হয় মিয়া। অন্যদিকে গির্জার অলঙ্করণে নিয়োজিত শিল্পী, একজন তস্কর, পানশালার হৈচৈয়ে মেতে থাকা একদল মানুষ এবং মৃত্যুপথযাত্রী এক কিশোরী। প্রত্যেকের জীবনই নানা জাগতিক যন্ত্রণায় পূর্ণ, কোথাও কারো জন্যে সুখের সন্ধান নেই।

মৃত্যু সম্পর্কিত শূন্যতার ভীতি যে সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেরিম্যানকে প্ররোচিত করেছিল, গির্জায় যাজক ভেবে মৃত্যুর কাছে দেয়া নাইটের স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে আসলে তিনি নিজেই এ সব অনুত্তরিত প্রশ্নের উত্তর জানতে চান। যেখানে মৃত্যু নিজেও জানে না কোথায় ঈশ্বর, সেখানে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান সামান্য মানুষকে চূড়ান্ত বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবে কে? কেন অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি আর অদৃশ্য অলৌকিকের সম্ভাবনার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন ঈশ্বর? কেবলমাত্র অনুমান এবং বিশ্বাসে সন্তুষ্ট হতে পারেন না ব্লক, তাই সঙ্গত কারণে এবং যৌক্তিকভাবেই তিনি বলেন, ‘আমি অনুমান বা বিশ্বাস নয় জ্ঞান চাই।’ এখানেও নাইটকে প্রতারিত করে দাবার ছকে তার পরিকল্পনার কথা আগেই জেনে নেয় মৃত্যু।   

‘দ্য সেভেন্থ সিলে’র কাহিনী এগিয়ে যাবার সাথে সাথে ধর্মের নানা ত্রুটি বিচ্যুতি এবং অসঙ্গতি একের পর এক উঠে আসতে থাকে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে যথাযথ প্রমাণের অভাব, যাজকদের নীতিহীন আচার আচরণ এবং নিজেদের অনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে সাধারণ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করার প্রবণতা যে মানুষকে ক্রমেই বিভ্রান্তির ভেতরে ঠেলে দিচ্ছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ধর্মবিশ্বাসের অপর্যাপ্ত ব্যাখ্যা এবং মানুষের দুঃখ দুর্দশার যৌক্তিক কারণ তুলে ধরতে ধর্ম যে একেবারেই অসমর্থ তাতে বøকের সন্দেহ ঘণীভূত করে।

আন্তনিয়াস ব্লক পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও তাঁর সন্দেহ ঠিকই প্রকাশিত হয়ে পড়ে যখন তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের ভীতির একটি মূর্তি তৈরি করে নিয়েছি, এই মূর্তির নাম ঈশ্বর।’ ধর্ম সম্পর্কিত দর্শনের তত্ত্ব প্রাথমিকভাবে মানুষের অজ্ঞতা ও ভীতি থেকে উৎসারিত। ডাইনি হিসাবে চিহ্নিত করে যে কিশোরীকে পুড়িয়ে মারার জন্যে নিয়ে আসা হয়, তার সাথে ব্লকের কথপোকথনের ভেতর দিয়ে এই বিশ্বাসের সত্যতাও উন্মোচিত হয়েছে। ব্লক মেয়েটির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তার সাথে যদি শয়তানের সাক্ষাৎ ঘটে থাকে তাহলে আদৌ ঈশ্বরের কোনো অস্তিত্ব আছে কিনা তাও তার জানার কথা। কিশোরী বলে, ‘আমার চোখের দিকে তাকাও। যাজক তাকে দেখেছে, সৈনিকেরাও দেখেছে, কিন্তু তারা আমাকে ছুঁতে পারবে না।’ উত্তরে নাইট বলেন, ‘আমি তো ভীতি ছাড়া কিছুই দেখছি না।’ কিছু পরে কিশোরীকে পুড়িয়ে মারার প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন প্রায় তখন জোনস বলে ওঠে, ‘ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেখানে শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই।’  

দ্বিধান্বিত ব্লক অবশ্য মনে করেন, ‘শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমদেরকে একটা সম্ভাবনার মধ্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে, সেখানে যদিও অতিপ্রাকৃত শক্তি হিসাবে মৃত্যুর অস্তিত্ব আছে, কিন্তু এরচেয়ে বড় এমন কোনো কাঠামো নেই যেখানে ঈশ্বর কোনো ভূমিকা পালন করেন।’ অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং শক্তি কেবল মৃত্যুর ভেতরেই দৃশ্যমান, মৃত্যুতেই সীমাবদ্ধ।  

ছবির আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্য একদল বিশ্বাসী মানুষের সম্মিলিত পদযাত্রা। দেশব্যাপী মহামারীর সংক্রমণকে তারা মনে করে ঈশ্বরের অভিশাপ আর এই শাপমুক্তির জন্যে শয়তানকে বিতাড়িত করতে তারা বেছে নিয়েছে আত্মনিগ্রহের পথ। ঈশ্বরের অনুকম্পা লাভের প্রত্যাশায় তারা কাঁধে বহন করছে কাঠের ভারি ক্রুশ, পরস্পরকে জর্জরিত করে চলেছে চাবুকের আঘাতে। ঈশ্বরের সাক্ষাৎ প্রতিনিধির মতো পদযাত্রার ধর্মগুরু প্রত্যেককে মনে করিয়ে দেন ‘কালো মৃত্যু প্রত্যেকের পেছনে তাড়া করে ফিরছে, এই দিনটিই হতে পারে তোমাদের জীবনের শেষ দিন। ঈশ্বরের ক্ষমা ভিক্ষা ছাড়া বাঁচার কোনো আশা নেই।’ পান্থশালায় সমবেত মানুষেরাও গুজব ছড়ায়। পশ্চিম উপকূলে প্লেগ ছড়িয়ে পড়েছে, মানুষ মরছে মাছির মতো। নানা অলৌকিক ঘটনার কথা উল্লেখ করে তারা, বিশ্বাস করে শেষ বিচারের দিন আসন্ন প্রায়। 

তবে জীবন মৃত্যু সম্পর্কিত অমীমাংসিত গভীর প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও ছবিটি পুরোপুরি রসিকতা বিবর্জিত নয়।  দাবার গুটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে মৃত্যু যখন কালো গুটি বেছে নেয় তখন মৃত্যুর সংলাপ, ‘কালোই আমার জন্যে যথোপযুক্ত’ একটি বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা। কামার প্লগের স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে তাকে উদ্ধার করা পর্যন্ত পুরো দৃশ্য কৌতুকের আবহ সৃষ্টি করে। অভিনেতার মৃত্যুর অভিনয় এবং শেষ পর্যন্ত সত্যিই মৃত্যুর হাতে পরাস্ত হওয়ার মধ্যেও রয়েছে সূক্ষ্ম হাস্যরস।  

শেষবার চাল দিতে বসে ব্লক ইচ্ছাকৃতভাবে দাবার গুটি এলোমেলো করে দিয়ে জফ এবং মিয়াকে মৃত্যুর হাত এড়িয়ে দূরে সরে যাবার সুযোগ সৃষ্টি করেন। একটি ভালো কাজের উদাহরণ রেখে সঙ্গীদের নিয়ে দুর্গে পৌঁছে যান নাইট, অবধারিত মৃত্যু তাদের অনুসরণ করে। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ নাইটকে জীবন ও মৃত্যুর যে রহস্য অনুসন্ধানের জন্য প্ররোচিত করেছিল, শেষ মুহূর্তে তার অবসান ঘটে। নাইট প্রার্থনার মতো উচ্চারণ করেন, ‘হে ঈশ্বর! যদি তোমার অস্তিত্ব থেকে থাকে এবং কোথাও তা নিশ্চয়ই আছে, তাহলে তুমি আমাদের ক্ষমা করো।’ অবিশ্বাসী জোনস নিশ্চিতভাবেই জানেন, মৃত্যুর পরে কোনো জগৎ নেই। তাই স্পষ্ট ভাষায় তিনি নাইটকে বলতে পারেন, ‘আপনার অভিযোগ শোনার বা দুর্দশায়  ব্যথিত হবার মতো কেউ কোথাও নেই!’

শেষ দৃশ্যে একদিকে দিগন্ত রেখা জুড়ে চলতে থাকে মৃত্যুর মিছিল আর অন্যদিকে জফ ও মিয়া তাদের শিশুপুত্রকে নিয়ে এগিয়ে যায় জীবনের যাত্রাপথে।  

চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগে সুইডেনের গ্রামীণ গির্জা, পানশালা এবং প্লেগের কারণে পরিত্যক্ত গ্রাম, পথঘাট, দুর্গ ও সমকালীন যানবাহন ছবিতে অসাধারণ নৈপুন্যের সাথে তুলে আনা হয়েছে। একই সাথে অভিনেতা অভিনেত্রীদের পোশাক পরিচ্ছদ, অভিব্যক্তির চমৎকারিত্ব ও অভিনয় নৈপুণ্য দর্শককে সমসাময়িক বাস্তবতার মধ্যে আটকে রাখে। নাইটের ভূমিকায় ম্যাক্সভন সিডো এই ছবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। মিয়ার ভূমিকায় বিবি এ্যান্ডারসন এবং স্কয়ার জোনসের চরিত্রে গুনার বোর্নস্ট্রান্ডসহ সকলেই চরিত্রের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন, নির্দ্বিধায় বলা যায়। 

‘দ্য সেভেন্থ সিল’ একই সাথে চিরায়ত এবং সমকালীন। শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারী সংক্রমণের দিনগুলোতে পৃথিবী যখন বিপর্যস্ত, ধর্ম ব্যবসায়ীরা যখন একে ঈশ্বরের অভিশাপ বলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করে, তখন চতুর্দশ শতকের ধর্ম বিশ্বাস ও সমাজ ভাবনা এখনো অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। ধর্ম বিশ্বাসের সাথে মানুষের অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের যে নিবিড় সম্পর্ক তা আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই ছবি।