হায়দার: কাশ্মীরের ঈদিপাস কমপ্লেক্স

বিধান রিবেরু প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২, ০৯:০০ এএম হায়দার: কাশ্মীরের ঈদিপাস কমপ্লেক্স

বিশাল ভরদ্বাজ সম্প্রতি শেক্সপিয়ারের ‘হ্যামলেট’কে পুঁজি করে বানিয়েছেন ‘হায়দার’। হায়দার দেখার পর উত্তেজিত বোধ করেছি। যতটা না ফ্রয়েডিয়ো বিষয়াদি মনে পড়ায় তারচেয়েও বেশী আন্দোলিত হয়েছি আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের দুর্দশার কথা মনে পড়েছে বলে। আহা তাদের শোষণ ও বঞ্চনা নিয়ে যদি সত্যিকার অর্থেই একখানা সৎ চলচ্চিত্র নির্মাণ হত! সৎ বলছি একারণে যে হায়দারকে আমার মুনশিয়ানা সমেত অসৎ চলচ্চিত্র মনে হয়েছে।

কাশ্মীরবাসীদের উপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অন্যায় অত্যাচার তেমনভাবে ভরদ্বাজের ছবিতে আসেনি- এমন অভিযোগ তুলেছেন কাশ্মীরের লোকজন। কিন্তু হ্যামলেটের কাহিনীকে যেভাবে হায়দারে কাশ্মীর পটভূমিতে মেশানো হয়েছে সেটাতে মুনশিয়ানা আছে সন্দেহ নাই। হ্যামলেটে মানবমনের যে গলিঘুপচি ফ্রয়েড সাহেব অনুসন্ধান করে বের করে এনেছিলেন সেই আবিষ্কৃত মনোবিশ্লেষণ তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবেই হাজির থেকেছে হায়দারে। হায়দারে ভরদ্বাজ চেষ্টা করেছেন কাশ্মীরকেই হ্যামলেট হিসেবে দাঁড় করাতে। ছবি দেখতে দেখতে আমার সেটাই মনে হয়েছে। পরে এক সাক্ষাৎকারে দেখলাম নির্মাতাও একই কথা বলছেন। যাই হোক, কাশ্মীরের হ্যামলেট হয়ে ওঠার মাধ্যমে ভরদ্বাজ ভারতমাতা ও কাশ্মীরের মাঝে পিতার আইনকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফ্রয়েড থাকলে হয় তো ঈদিপাস কূট বা কমপ্লেক্সের কথা বলতেন। বলতেন, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রনীতির সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর মতই।  কাজেই কাশ্মীরের পক্ষে রাষ্ট্রনীতিকে “কতল” করা সম্ভব নয়, এতে ভারতমাতা চোট পেতে পারেন- এহেন ভাবনা কাশ্মীরবাসীদের মধ্যে ঘুরপাক খেতেই পারে -এমন সব মজার বিশ্লেষণই হয় তো করতেন জিগমুন্ট ফ্রয়েড।

ফ্রয়েড নিজের প্রস্তাবের পক্ষে নমুনা হিসাবে নানা সময়েই বিভিন্ন সাহিত্যকর্মকে হাজির করেছেন, তার মধ্যে হ্যামলেট একটি। যেহেতু মনোবিশ্লেষণে ফ্রয়েড হ্যামলেটকে স্মরণ করেছেন এবং একই উছিলায় ঈদিপাসকেও ইস্তেমাল করেছেন তাই হায়দারকে ফ্রয়েড ছাড়া পাঠ করা প্রায় অসম্ভব। একারণেই হ্যামলেটের ভারতীয় সংস্করণ হায়দার কাশ্মীরের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হলেও এই চলচ্চিত্রকে পাঠ করেছি ফ্রয়েডকে সঙ্গে নিয়েই।

এই ছবিতে ভরদ্বাজ নিদেন পক্ষে চারবার বলেছেন প্রতিহিংসা প্রতিহিংসারই জন্ম দেয় কেবল। আজাদি থেকে যায় অধরা। মানে পরিচালক বরাবরই বলার চেষ্টা করছেন- কাশ্মীরবাসীদের- রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন। অযথা হিংসা ও প্রতিহিংসার ব্যবসায় নিজেদের জড়াবেন না, সে যতই সেনাবাহিনী আপনাদের অত্যাচার, গুম ও খুন করুক না কেন! এই ছবিতে দেখান হয় হায়দারের চাচা, ক্লদিয়াস ওরফে খুররমই হল আসল শয়তান, তার রাজনৈতিক ফায়দার জন্য সে ব্যবহার করছে সেনাবাহিনীকে। হায়দারের বাবা মিরকে তো সেনাবাহিনী মারে নাই, মেরেছে চাচা খুররম। মায়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে মঞ্চনাটকের মাধ্যমে এই সত্যই প্রতিষ্ঠা করে হায়দার। এর মধ্য দিয়ে মূল হ্যামলেটের সঙ্গে মিলটাও রাখা হল আবার ভারতীয় সেনাবাহিনীকেও আড়াল করা গেল। বেশ চতুর চিত্রনাট্য বলতে হবে। পরিচালকের কথা হল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া যাবে না। রাষ্ট্র নিপীড়কের ভূমিকা নিলেও না। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় রয়েছে রাষ্ট্রীয় আইন। এই আইনকে আপনি বলতে পারেন পিতার বা ভাষার আইন। আপনি রাষ্ট্রের নাগরিক মানেই এই সিম্বলিক অর্ডারে আপনি প্রবিষ্ট হন। এবং এর দ্বারা চালিত হন। ধারণাটি ধার করেছি ফরাসি বাড়ির ভাবুক জাক লাকাঁর কাছ থেকে।

জাক লাকাঁর ল অব ফাদার এমন এক আইন, যে আইন দ্বারা মা ও সন্তানের সম্পর্ক নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এই আইন হলো ভাষার আইন, লাকাঁর ভাষায় সিম্বলিক অর্ডারে প্রবেশ করলে এই আইনের অধীন হয় মানুষ। এখন কাশ্মীর তথা ভারত উপমহাদেশ যখন সিম্বলিক অর্ডারে প্রবেশ করল, মানে যখন ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হয়ে স্বাধীন ভারতের অধীন হল তখন থেকেই সে নতুন পিতৃআইনের অন্তর্ভুক্ত হল। অনেকটা হায়দারের প্রথম পিতার কাছ থেকে দ্বিতীয় পিতার কাছে যাওয়ার মত! অর্থাৎ ভারতমাতার সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পর্ক নির্ধারিত হচ্ছে রাষ্ট্রের নীতি দিয়ে। এই নীতিই হলো কাশ্মীরের জন্য পিতৃআইন। এই আইন রক্ষা করে সেনাবাহিনী। রক্ষা করতে গিয়ে খুন, ধর্ষণসহ নানা অন্যায়ই তারা সংঘটিত করে। বিশেষ আইনের জোরে জোরজবরদস্তি তো আছেই। সেসবের কিছু অংশ আমরা দেখতে পাই হায়দার ছবিতে। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রশংসাও রয়েছে এতে। ঢালাওভাবে। বলা হয় ভারতের সেনাবাহিনী বিশ্বের চৌকশবাহিনীর মধ্যে একটি ইতি ও আদি। আর এই বিষয়টিই পছন্দ করতে পারছেন না কাশ্মীরবাসীদের অনেকেই। এক অনলাইন পত্রিকায় দেখেছি নাপসন্দের বিষয়টি খোলা চিঠির মাধ্যমে পরিচালককে জানিয়েছেন এক কাশ্মীরবাসী।

শহীদ কাপুর অভিনীত হায়দার চরিত্রটি যেমন দ্বিতীয় পিতার আইনের দ্বারা শাসিত হয়ে মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখে তেমনি কাশ্মীরও রাষ্ট্রনীতির চোখ রাঙানির মাঝেই টিকে আছে ভারতমাতার সঙ্গে। পিতার আইন অমান্য করলে চলচ্চিত্রের মায়ের (টাবু) মত ভারতমাতাও মৃত্যুবরণ করবে- এমনটাই বলার চেষ্টা করেছেন ভরদ্বাজ। কারণ আগেই বলেছি, তিনি বারবার বলছেন প্রতিহিংসা দিয়ে কিছু অর্জিত হয় না। আর আজাদীর পেছনে পাকিস্তান তথা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার হাত আছে সেটাও একাধিকবার এসেছে চলচ্চিত্রে। কাজেই ভারতে হায়দার নিষিদ্ধ হলেও হায়দার মূলত ভারতের মূল রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরের চেয়ে পৃথক কিছু নয়। বরং তাদের হয়ে ভরদ্বাজ বলেছেন, বিদ্যমান আইন মেনেই কাশ্মীরকে ভারতমাতার সঙ্গে থাকতে হবে। তবে ছবির ভেতরে সহানুভূতির কপট প্রলেপ অবশ্য আছে।

ভরদ্বাজের ভঙ্গিখানা হল ছবি তিনি বানিয়েছেন কাশ্মীরের জনগণের যে দু:খ, দুর্দশা সেটি তুলে ধরতে। সেনাবাহিনী তাদের সঙ্গে কত খারাপ ও অন্যায় আচরণ করে সেটাই যেন ভরদ্বাজের কহতব্য। কিন্তু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, না, ভরদ্বাজ ভঙ্গিটা নিয়েছেন কাশ্মীরের আজাদীর পক্ষে কিন্তু উপদেশ দিচ্ছেন ভারতীয় সরকারের মুখপাত্র হয়ে। তিনিই যেন স্বয়ং রাষ্ট্র! বলছেন, সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলা যাবে না! আর এখানেই প্রকাশ পাচ্ছে পরিচালকের অসততা।

একটি জনগোষ্ঠী কেন আজাদী চায় বা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় সেটার নিশ্চিতভাবেই একটা ইতিহাস থাকে। সেই ইতিহাসের পথ মাড়াননি ভরদ্বাজ। তিনি হ্যামলেট রূপী হায়দারকে শুধু বসিয়ে দিয়েছেন কাশ্মীরে। বিক্রি করার চেষ্টা করেছেন শেক্সপিয়ারকে। তাতে অবশ্য অসফল হননি। কিন্তু শেক্সপিয়ার, হ্যামলেট, মা ও ছেলের সম্পর্ক, ঈদিপাস কমপ্লেক্স ইত্যাদির ডামাডোলে কাশ্মীরের জনগণ কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের জন্য লড়াই করছে সেটা ঢাকা পড়ে যায়। বা বলা যায় সেটাকে চিত্রনাট্যে স্থানও দেননি পরিচালক। ছবির শেষেও সেনাবাহিনীর স্তুতি গেয়েছেন তিনি। অতয়েব হায়দার নিয়ে যেটা বলতে চাই তা হল- এই ছবিতে মুনশিয়ানা আছে আবার অসততাও আছে।