২০২১ সালের এপ্রিলে পরিচালক সঞ্জয় লীলা বানসালী ‘হীরামান্ডি’ নিয়ে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন; যদিও তিনি এটা নিয়ে চিন্তা শুরু করেছেন আরো ১৪ বছর আছে। ২০২৩ সালের জুন মাসে প্রোডাকশনের কাজ শেষ হয়েছিল। ২০২৩ সালে নেটফ্লিক্সের সিইও টেড সারানডোসের সাথে আলাপচারিতায় বানসালি তার ‘হীরামান্ডি’ টিভি সিরিজের কাজটাকে বানসালির জীবনের সব থেকে বড় প্রজেক্ট হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। সঞ্জয় লীলা বানসালি হীরামান্ডি টিভি সিরিজ তৈরিকে, ভারতের মাদার ইন্ডিয়া (১৯৫৭), মুঘল-ই-আজম(১৯৬০) এবং পাকিজাহ (১৯৭২)— এই তিনটি জরুরি চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত সম্মান প্রদর্শন হিসাবে দেখছেন। ২০২৪-এর মে মাসে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে, আট পর্বের ‘হীরামান্ডি।’
‘হীরামান্ডি’ টিভি সিরিজটাতে অনেক ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে বিতর্কের সুযোগ আছে। যদিও দিন শেষে এটা শুধুই একটা টিভি সিরিজ কিন্তু ১৯২০ সালের দিকে, লাহোরে কী হচ্ছিলো, হীরামান্ডি তে কী হচ্ছে, বালুচ বা বেলুচিস্তানের মানুষজন আসলে লাহোরে সেইভাবে ছিল কিনা বা তারা কি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য লড়াই করেছে, নাকি শুধু বালুচিস্তানের স্বাধীনতা চেয়েছে? এসব শতশত প্রশ্ন তৈরি করে হীরামা্ন্ডি। নবাবদের কার্যকলাপ, ইংরেজদের সাথে তাদের যোগাযোগ এবং দেশ শাসনে নবানদের সহযোগিতা সব কথাই উঠে এসেছে হীরামান্ডিতে। সেগুলো নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাতে ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম (তার উপর আবার এমন সময়ে যখন বর্তমান ভারতে চলছে লোকসভা নির্বাচন)। হীরামান্ডির কাজটাকে অরাজনৈতিক বলার কোনো সুযোগ নেই। ফিকশন বলে এর রাজনীতিকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। ভাষার ব্যবহারে হিন্দি-উর্দু শব্দই বেশি ছিল, যেখানে অনেক ফার্সি শব্দ এসেছে কিন্তু লাহোরে যে ভাষায় কথা বলা হতো সেইটা নিয়ে অনেকের দ্বিমত আছে। আরো ভালো বুঝবেন যারা লাহোরের ভাষাটা জানেন। আর অনেকেই বিরক্ত হবেন বিশেষ করে যারা শুধুই বিনোদনের জন্য, সময় কাটানোর জন্য হীরামান্ডি দেখবেন। হীরামান্ডি শুধু সময় কাটানোর জন্য বানানো কোনো কাজ না। এটা আমি নিশ্চিত। প্রায় দুই বছর ধরে কাজ চলেছে। আটটা সুদীর্ঘ পর্ব। ব্যপক আয়োজন। বিস্তর গবেষণা। সেট ডিজাইন বিশাল। একেবারে সেই সময়কে , সেই লাহোরকে, সেই হীরামান্ডি কে তুলে দর্শকের সামনে আসা হয়েছে।
হীরামান্ডি শব্দটা একটা জায়গার নাম । এর অর্থ হীরার বাজার। বর্তমান পাকিস্তানের ওয়ালেড শহরে অবস্থিত এই এলাকাটি। প্রথমে নাম ছিলো হীরা সিং ডি মান্ডি। মানে হীরা সিং-এর বাজার যেখানে শস্য বেচাকেনা হতো। বিখ্যাত তাকসালী দারওয়াজা এবং মোগল আমলের বাদশাহী মসজিদ সেখানেই অবস্থিত। নৃত্য এবং গীতের সাথে সম্পর্কিত একটা বড় কমিউনিটি সেখানে বসবাস করত, যারা তাওয়ায়িফ সংস্কৃতিকে লালন করতো। অস্ত্র আর গায়ের জোরে, ব্রিটিশদের ভারতীয় উপমহাদেশ দখলের পর এই তাওয়ায়িফ, নাচগানের সংস্কৃতিক বলয়কে তারা দেহব্যবসার দিকে নিয়ে যায় বা বাধ্য করে। ব্রিটিশদের এই এলাকার প্রচলিত সাংস্কৃতিক চর্চাকে টিকিয়ে রাখার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। তারা তাদের চিন্তা-ভাবনা আর ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে এই সাংস্কৃতিক চর্চাটাকেও নষ্ট বা দূষিত করে দেয়। স্বাধীনতার পর এই তাওয়ায়িফদের অনেকেই লাহোরের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করেছেন এবং বিখ্যাত হয়েছেন। ইতিহাসের গভীর পাঠ জরুরী। কারণ ইংরেজ শাসক বা শোষকরা অনেককিছুর সংজ্ঞা তৈরি করে দেন। যে ইংরেজ শহরের নাম পরিবর্তন করে দিতে পারে, মানুষের নাম বদল করে দিতে পারে, সেই ইংরেজ আরো অনেককিছুই পরিবর্তন করে দিবে।
হীরামান্ডি টিভি সিরিজের কেন্দ্রীয় অধিকাংশ চরিত্রে আছেন তোয়াইফরা। আজকের দুনিয়াতে গজলকে আমরা উঁচুস্তরের মর্যাদা দিয়ে থাকি। আমরা জানি যে পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে গজল একটা গুরুত্বপূর্ণ আর্ট-ফর্ম। দুশো থেকে চারশ বছর ধরে যারা এই আর্ট-ফর্মটাকে টিকিয়ে রেখেছেন তারা কারা? তারা এই তোয়ায়িফ। সময়ের পরিক্রমায় আমরা যাদেরকে অসম্মান করেছি। ইংরেজরাও নিজেদের স্বার্থে তাদের ব্যবহারের চেষ্টা করেছে; আর সাথে আছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিজস্ব রাজনীতি। যখন ইংরেজরা বুঝতে পেরেছে যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে, অসহযোগ আন্দোলনে তোয়ায়িফদের সংশ্লিষ্টতা আছে, তখন থেকেই তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়।
হীরানান্ডি গল্পের একটা বিশেষ তাৎপর্য হলো এখানে স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের অংশগ্রহণ দেখানো হয়েছে তারা হয় মুসলিম সম্প্রদায়ের নয়তো শিখ। আর গল্পটা লাহোরের, ১৯২০ সালের, অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের, যখন লাহোর পাকিস্তান ছিলো না, লাহোর ছিলো ব্রিটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর।
টিভি সিরিজ হলেও ‘হীরামান্ডি’ সিনেম্যাটিক কাজই হয়েছে আমি বলবো। এমন অনেক জায়গাতেই আপনার মনে হবে যে এটা বড় পর্দায় আরো অর্থপূর্ণ মনে হতো। যেখানে যে শট দরকার সেই শটটাই যেন হয়েছে। বার্ডস আই ভিউতে শেষ পর্বের শেষ দৃশ্যটা আপনের চোখে লেগে থাকবে, যেখানে জেলের মূল দেয়ালের বাইরে তোয়াইফরা মশাল হাতে মিছিল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, আর ভেতরে বুবুজানকে গুলি করে হত্যার জন্য ইংরেজরা বন্দুক তুলে নিচ্ছে।
বলে রাখা ভালো, বাংলায় ‘রাজকাহিনি’ (২০১৫) এবং হিন্দিতে ‘বেগম জান’ (২০১৭) তৈরি করেছিলেন সৃজিত মুখার্জী। সেখানেও মূল চরিত্রে ছিল এই তোয়াইফরা। সৃজিতের ছবির অবশ্য মূল থিম ছিল ভারত ভাগ।