উৎসব

টিফের সাত-সতের

বিধান রিবেরু প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৩, ০৪:০৬ পিএম টিফের সাত-সতের
৪৮তম টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে লেখক

করোনা মহামারীর ধকল কাটিয়ে, হলিউডে চলচ্চিত্র কারখানা সংশ্লিষ্টদের ধর্মঘট মাথায় নিয়ে ৪৮তম টরন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (টিফ) অনুষ্ঠিত হয় ২০২৩ সালের ৭ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর। এই এগার দিনে আমি ছবি দেখি মোট ২৬টি। উপস্থিত থাকি ওদের ভিশনারিজ শিরোনামের একটি আলোচনায়। এবারের সফরে আমার চাঁদমারি ছিল এশিয়া অঞ্চল। তবে দুই-একটি অন্য মহাদেশের ছবিও দেখেছি বৈকি। 

আমার দেখা ছবি ও উৎসবে স্থান পাওয়া বাকি ছবিগুলোর তালিকা দেখলে বোঝা যায় টিফ চেষ্টা করে বিশ্বের অন্য মর্যাদাপূণ উৎসবের আলোচিত ও প্রশংসিত ছবিগুলোর একটি কাফেলা উপস্থাপনের। সেদিক থেকে এই উৎসবের একটি আলাদা গুরুত্ব আছে। যেমন তাদের একটি মূল বিভাগের নাম কনটেম্পরারি ওয়ার্ল্ড সিনেমা, যদিও এবার এই বিভাগের নাম পাল্টে রাখা হয়েছে সেন্টারপিস। প্রকৃত অর্থেই এই বিভাগটি মধ্যমণি। তো মূলবেণীতে থাকা ৪৫টি দেশের ৪৭টি ছবির ভেতর ৯টি চলচ্চিত্র আমি দেখেছি। তন্মধ্যে সর্বাগ্রে রাখবো নুরি বিলগে জেলানের ‘অ্যাবাউট ড্রাই গ্রাসেস’। ন্যায় ও অন্যায়ের স্বরূপ নিয়ে, ভাবাদর্শের প্রয়োজনীয়তা-অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে এক ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব হাজির করেন পরিচালক এই ছবিতে। আর জেলানের অন্য কাজ যারা দেখেছেন তারা জানেন, এই পরিচালক কোন মেজাজের ছবি নির্মাণ করেন। ‘সেন্টারপিসে’র আরো দুটি ছবির নাম যদি উল্লেখ করতে হয়, তবে বলবো, জেমিল আগাজিকগলু পরিচালিত ‘দ্য রিডস’ ও এন্থনি চেনের ‘দ্য ব্রেকিং আইসে’র কথা। বিশুদ্ধ আর্টফিল্ম ঘরানা যাদের পছন্দ, তাদের কাছে এই ছবি দুটি আদরনীয় হবে। 

টিফের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ডিসকভারি। যেসব নির্মাতা বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজেদের নাম লেখাতে পারেন বলে মনে করে টিফ, সেই নবীন নির্মাতার ছবি এই বিভাগে স্থান পায়। ডিসকভারি বিভাগ থেকে আমি দেখেছি পাঁচটি ছবি। সেগুলোর ভেতর সবচেয়ে ভালো লেগেছে ইরানি ছবি ‘একিলিস’কে। ফরহাদ দেলারামের প্রথম ছবি। ভীষণরকম রাজনৈতিক ও রূপকধর্মী কাজ। দ্বিতীয় আরেকটি ছবি উল্লেখযোগ্য—সৌদি আরবের নির্মাতা আলি কালথামির প্রথম চলচ্চিত্র ‘মানডুব’। মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়ার দেশ হিসেবে সৌদি আরবের চলচ্চিত্র খুব একটা দেখা হয়নি আগে। যদিও একই অঞ্চলের ইরানের অনেক ছবি দেখেছি। টিভিতে, চলচ্চিত্র উৎসবে। বাংলাদেশে ইরানি সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সুবাদে বহু আগে থেকেই তাদের ছবি আমরা দেখার সুযোগ পেয়েছি। তবে সৌদি আরবের ছবির প্রসার পুরো পৃথিবীতেই আসলে কম।

সেন্টারপিস ও ডিসকভারি ছাড়াও টিফের গালা, প্লাটফর্ম, স্পেশাল প্রেজেনটেশন্স, ডকস অ্যান্ড লুমিনারিজ, প্রাইম টাইম, ওয়েভ লেংথ ও প্রিমিয়াম বিভাগগুলো থেকেও ছবি দেখেছি। দক্ষিণ কোরিয়ার ছবিগুলো ছিলো মিডল সিনেমার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তবে উল্লিখিত বিভাগ থেকে আমার দেখা সেরা তিনটি ছবি হলো: ‘এভিল ডাজ নট এক্সিস্ট’, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্যামিলি’ ও ‘নাইয়াড’। এই তিনের ভেতর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্যামিলি’ প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক আনন্দ পটবর্ধনের সঙ্গে আমার আলাপ হয় প্রথমবারের মতো। তাঁর কাজ সম্পর্কে আমার পূর্বধারণা থাকায় আলাপ করতে সুবিধা হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ সম্পর্কে আনন্দের আলাদা আগ্রহের বিষয়টিও আমাকে সহযোগিতা করেছে তার কাছাকাছি যেতে। উৎসবে একাধিকবার তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় আমার। আমি বলবো, শুধু উপমহাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই প্রণিধানযোগ্য রাজনৈতিক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতাদের ভেতর তিনি একজন।

আনন্দের প্রামাণ্যচিত্রটি ছাড়া ভারত থেকে আসা আমার দেখা অন্য ছবিগুলো মনে তেমন দাগ কাটেনি। যদিও ‘ডিয়ার জেসি’ ছবিটি প্লাটফর্ম প্রাইজ পেয়েছে। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে এই ছবির নায়ক ইয়ুগাম সুদ এসেছিলেন, পরিচালক তারসিম সিংয়ে সাথে। আমার পাশেই সুদ দাঁড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু পুরস্কার প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় দেখলাম বেচারা সুদকে ডায়াসে ডাকলেন না পরিচালক সিং। যাক, পরে হালকা নাস্তা পর্ব চলার সময় সুদকে আমি অভিনন্দন জানাই। সত্যি কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিতে উঠে এসেছে ‘অনার কিলিং’য়ের বিষয়টি। যদিও পরিচালক পুরস্কার হাতে নিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, কেউ যেন এই ছবিটিকে অনার কিলিং বিষয়ক ছবি না বলেন। এতে করে নাকি বর্বরতাকে ঢেকে দেয়া হয়। তবে আমি মনে করি, ধারণাগত দিক থেকে হত্যাকাণ্ডের ধরন বোঝাতে ‘অনার কিলিং’ বললে খুব একটা ক্ষতি নেই।

এই ছবিটি ছাড়াও, টিফের শীর্ষ পুরস্কার পিপলস চয়েজ এওয়ার্ড পায় কর্ড জেফারসনের ছবি ‘আমেরিকান ফিকশন’। যেহেতু আমার তালিকা আমি সীমাবদ্ধ রেখেছিলাম এশিয়ার ছবিতে, তাই এই মার্কিন প্রযোজনাটি দেখা হয়নি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ ঔপন্যাসিকের হতাশাকে কেন্দ্র করে বানানো ছবিটি দর্শক বেশ পছন্দ করেছে। অপরদিকে রবার্ট ম্যাকক্যালামের প্রামাণ্যচিত্র ‘মিস্টার ড্রেসআপ: দ্য ম্যাজিক অব মেক-বিলিভ’ অর্জন করেছে পিপলস চয়েজ এওয়ার্ড ডকুমেন্টারি শাখার সেরা হওয়ার গৌরব। এই দুটি পুরস্কারই টিফের মূল পুরস্কার। প্রতিযোগিতায় থাকা ছবিগুলোকে স্ক্রিনিংয়ে আসা মানুষ ভোটের মাধ্যমে জয়যুক্ত করে। কাজেই বোঝা যাচ্ছে টিফ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় তার দর্শকদের। তাই প্রতিটি ছবি শুরুর আগে যে প্রমোশনাল চালানো হতো, সেখানে থাকত দর্শকদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন। 

টিফের আরো একটি বিভাগ রয়েছে, ধ্রুপদি শাখা: টিফ ক্লাসিকস। এই শাখায় আমার খুব প্রিয় পরিচালক উসমান সেমবেনের ‘হালা’ দেখানো হয়েছে। আরেক সেনেগালি পরিচালক জিব্রিল ডিয়প ম্যামবেতির ‘টুকি বুকি’ও দেখানো হয় এবারের উৎসবে। এছাড়া জ্যাক রিভেতের ‘লামুর ফু’, ব্রিজিত বারম্যানের ‘আর্টি শ: টাইম ইজ অল ইউ হ্যাভ গট’ ও চেন কেইজের ‘ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন’ ছবি তিনটিও রাখা হয় ধ্রুপদী বিভাগে।

উৎসবে কি মানুষ শুধু ছবিই দেখতে আসে? আমি তো দেখেছি মানুষে মানুষে মিলন এবং যোগাযোগ স্থাপনের জন্যও আসে। উৎসবে বাজার একটি বড় ভূমিকা পালন করে সন্দেহ নেই। যেমন টিফে প্রদর্শিত নতুন ছবি দেখতে অনেক বড় বড় পরিবেশক আসেন, ছবি পছন্দ হলে তারা যোগাযোগ করেন প্রযোজকদের সাথে। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির বিষয়ে কথা বলেন। চলচ্চিত্রের এই বাণিজ্যের জন্য টিফের অবশ্য আলাদা শাখাও রয়েছে, নাম মার্কেট স্ক্রিনিং।


বাণিজ্য বাদ দিল, সিনেমাপ্রেমীদের মাঝে যে মেলবন্ধন হয় উৎসবে তা অতুলনীয়। বিশেষ করে চলচ্চিত্র শুরুর আগে ও পরে। চলচ্চিত্র নিয়ে আলাপ ও প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ভাবনার আদান-প্রদান ঘটে। টিফের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহের আশপাশেই রয়েছে খানাপিনার ব্যবস্থা। সেখানেও চলে সিনেমার আলাপ। তবে টিফের সাংবাদিকদের জন্য লাউঞ্জের প্রশংসা করতেই হয়। নিবিড়ভাবে কাজের এমন পরিবেশ সত্যি বিরল। সকলরকম সুযোগ-সুবিধা মজুদ ছিলো। কাজপ্রিয় সাংবাদিক ও লেখকদের জন্য টিফের প্রেস লাউঞ্জ খুবই চমৎকার জায়গা। তবে দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, অনেকেই আছেন, যারা মিডিয়া এক্রেডিটেশন কার্ড নেন ঠিকই, কিন্তু যে কাজের জন্য উৎসব তাদের অনুমোদন দিয়েছে, সেই কাজটি তারা করেন না। কেউ শুধু কার্ড ঝুলিয়ে ছবি দেখতে আসেন, কেউবা পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে। অবশ্য এরকম একদল লোক আছেন, যারা শুধু উৎসবে যেতেই পছন্দ করেন। না আছে তাদের ছবি সম্পর্কে আগ্রহ, না আছে লেখালেখির কোনো ইচ্ছা বা দক্ষতা। এদের প্রতি সমবেদনা।

টিফের মূল ভবন লাইটবক্সের নীচতলায় একটি দোকান রয়েছে, সেখানে অল্প পরিসরে থরে থরে সাজিয়ে রাখা বইয়ের সম্ভার আমাকে বেশ আকৃষ্ট করেছে। বিষয়ের দিক থেকে বিচিত্র সব সিনেমা বিষয়ক বই তো রয়েছেই, নির্মাতাদের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক বইয়েরও একটা বড় সংগ্রহ রয়েছে সেখানে। পাশাপাশি দর্শনের গুটিকয়েক বইও আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। তবে বইয়ের চাইতে, উৎসবের স্মৃতিস্মারক সংগ্রহেই মানুষের বেশি মনোযোগ লক্ষ্য করেছি। এই প্রবণতা অবশ্য বিশ্বব্যাপী রয়েছে।

টিফের আরো দুই একটি দিক না বললে, বলাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। সেটি হলো টিফকে কেন্দ্র করে প্রথম চারদিন প্রতি সন্ধ্যায় হওয়া কনসার্ট। এবং আরেকটি হলো স্ট্রিট ফেস্টিভাল, এখানে নানা ধরনের আয়োজন ও খাবার নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেন বিভিন্ন ছোট ছোট দোকানিরা। উৎসবমুখর করে তুলতে এই দুই আয়োজনের তুলনা নেই।

আরেক দল মানুষ ছাড়া উৎসবকে আলুনি মনে হতেই পারে। তারা হলেন হকার। তবে এরা ঠিক বাংলাদেশের হকারদের মতো নয়। ভ্যারাইটি, স্ক্রিন, হলিউড রিপোর্ট, ব্যাকস্টেজের মতো পত্রিকাগুলো উৎসবকেন্দ্রিক বিশেষ সংখ্যা বের করে, সেসব ইস্যুগুলো এই হকারেরা বিলি করেন উৎসবে আসা মানুষদের মাঝে। তাদের ডাকাডাকি ছাড়া যেন উৎসবকে ঠিক উৎসবই মনে হয় না। আমি পড়ার জন্য তো বটেই, স্মারক হিসেবেও সংগ্রহ করি এসব পত্রিকা। 

টিফ বিশ্বের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব। এখানেও অন্যদের মতো রেডকার্পেট আছে, তারকাদের আনাগোনা আছে, পুরস্কার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব-নিকাশ আছে, এসবের পরও টিফে বাড়তি একটি জিনিস রয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে, সেটি হলো এর আন্তরিকতা। সারা দুনিয়া থেকে আগত সাংবাদিক, চলচ্চিত্র লেখক ও সমালোচকদের তারা যেভাবে সমাদর করেন সেটি অপরূপ। এর মাধ্যমে তারা পরস্পরের সঙ্গে একটি চলচ্চৈত্রিক যোগাযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেন আদতে। উত্তর আমেরিকার উৎসব হলেও ইউরোপ ও এশিয়া থেকে অনেকেই অংশগ্রহণ করেন টিফে। এর বড় একটি কারণ সেসব অঞ্চলের অনেক সাংবাদিকই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন উত্তর আমেরিকায়। অবশ্য শুধু টিফের জন্য হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছেন সেরকম লোকের সংখ্যাও কম নয়। আমিই তার উদাহরণ। নানা জাতি-বর্ণ-রাষ্ট্রের মানুষের পাশাপাশি নানা লিঙ্গের মানুষের অংশগ্রহণে টিফ উত্তরোত্তর সত্যিকার অর্থেই এক বর্ণিল উৎসবে রূপ নিয়েছে। এই অভিযাত্রা তারা অব্যাহত রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।