ভূমিকা ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ: তারেক আহমেদ
বেবী ইসলাম বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। কেবল ঋত্বিক ঘটকের শেষ দুটো ছবির ( ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ও ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’) চিত্রগ্রাহক হিসেবেই নয়; বাংলাদেশ স্বাধীনের আগে থেকেই যে মানুষেরা আমাদের চলচ্চিত্রের ভিত গড়ে তোলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন - বেবী ইসলাম তাঁদের একজন। বেবী ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ সালের ৩ জানুয়ারি ভারতের মুর্শিদাবাদে। কলকাতায় মেট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। পড়তে পড়তেই চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। ভারতের প্রখ্যাত পরিচালক অজয় করের হাত দিয়ে তাঁর হাতেখড়ি। কাজ করতে করতে একটা সময় চলচ্চিত্র বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইতালি যান, বেশি দিন থাকা হয়নি সেখানে। দেশে কিছু করার বাসনা নিয়ে ফিরে আসেন।
পঞ্চাশের দশকের সুপারহিট ভারতীয় বাংলা ছবি ‘হারানো সুরে’র আলোকচিত্রী ছিলেন তিনি, এছাড়াও ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’ (১৯৬৮), ‘নীল আকাশের নিচে’ (১৯৬৯), ‘ক খ গ ঘ ঙ’ (১৯৭০), ‘একাত্তরের যীশু’ (১৯৯৩) ইত্যাদি বহু দর্শকপ্রিয় ছবির ক্যামেরাম্যান ছিলেন তিনি। নির্মাণ করেছেন ‘তানহা’ (১৯৬৪) ও ‘চরিত্রহীন’ (১৯৭৫)। চিত্রগ্রহণ ও পরিচালনা ছাড়াও তিনি প্রযোজনা করেছেন। একটা সময় প্রাতিষ্ঠানিক কাজেও জড়িত হয়েছিলেন, এফডিসির জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে। তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন ২০১০ সালের ২৪ মে। এক দশক আগে প্রয়াত এই গুণী মানুষটি ১৯৭৫, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫— এই তিন বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক হিসেবে।
বেবী ইসলামের সাথে আমার পরিচয় আশির দশকের শেষ দিকে। বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামে’র সাংগঠনিক কাজে জড়িয়ে পড়ার কারণে সে সময় বেবী ভাইসহ আরো অনেকের সাথে পরিচয় ঘটে। এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে একজনের কথা না বললেই নয়, তিনি প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ। শর্ট ফিল্ম ফোরামের সে সময়কার সভাপতি তারেক ভাই হয়তো বেবী ভাইয়ের টানেই এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারটি সম্পাদনা করে একে ছাপার উপযোগী করে তুলেছিলেন। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের মুখপত্র ‘অন্যছবি’র দ্বিতীয় সংখ্যায় (আগস্ট ১৯৯৪) সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়। চলচ্চিত্র গবেষক ও আলোকচিত্রী শামসুল আলম বাবুকে প্রসঙ্গক্রমে কৃতজ্ঞতা জানাই, সম্প্রতি তিনিই তাঁর সংগ্রহে থাকা পত্রিকাটি থেকে সাক্ষাৎকারটির ফটোকপি সরববাহ করেন। সম্প্রতি এই সাক্ষাৎকারটি দুর্লভ হয়ে উঠেছে, মাঝে পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই এই সাক্ষাৎকার থেকে পাওয়া তথ্য ব্যবহার করেছেন, অথচ তাদের তথ্য ঋণ স্বীকার করতে দেখা যায়নি। সাক্ষাৎকারটি সহজলভ্য করতে ‘সিনেমা দর্শন’ পত্রিকায় আবারো প্রকাশ করা হলো।
তারেক আহমেদ: আপনার শুরুটা হয়েছিলে কলকাতায়, সেখানেই কাজ করছিলেন, পরে বোম্বেতে-মাদ্রাজেও চলে গিয়েছিলেন। তা হলে এখানে অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কি করে চলে এলেন?
বেবী ইসলাম: ’৫৬ সনেই এখানে চলে আসি। আসার পর আমার চাকুরী হয় পাবলিক রিলেশনস ডিপার্টমেন্টে। সেখানেই কাজ করছিলাম, কাজ করতে করতে এখানে ষ্টুডিও হলো ১৯৫৭ সালে। নাজীর আহমদ, তাঁরই উদ্যেগে এই কাজটি হলো, তিনি যদি এটা না করতেন তো আমি বলবো আমাদের এখানে এই চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে উঠতে পারতো না।
আমি এখানে এসেছিলাম চাকুরী নিয়েই, কিন্তু দেখা গেল সরকারী চাকুরীতে যা মাইনে দেয়, তাতে আমার পোষায় না। ফলে ১৯৫৮ সনে চাকুরীটা ছেড়ে দিলাম। নাজীর আহমদের অবশ্যি খানিকটা রাগ ছিলো আমার ওপর, কারণ চাকুরীটা আমি ছেড়ে দিই। উনিই তো আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন চাকুরী দিয়ে। এই চাকুরীর ব্যাপারটাও ঘটে খুব আকস্মিকভাবে। কলকাতায় থাকতে শুটিং করে ঘরে ফিরেছি, এসেই অভ্যাসমতো একদিন লেটারবক্স খুলেছি; যেমন প্রতিদিন খুলি— দেখি কোন চিঠিপত্র নয়, একটিমাত্র পেপার কাটিং। করাচিতে একজন ক্যামেরাম্যান নেয়া হবে। ইষ্ট পাকিস্তানের সবাই আমায় তখন শুধু ইনসিস্ট করতো, বলতো—এখানে চলে এসো। আমি সেইজন্যেই পাকিস্তানে ডিপার্টমেন্ট অব ফিল্ম এন্ড পাবলিকেশন্সে চাকুরীর জন্যে দরখাস্ত করলাম। ১৯৫৬ সনের শেষের দিকের কথা এটা। তখন কলকাতায় আমি দুটো ছবির কাজ করছি-‘হারানো সুর’ আর ‘বড় দিদি’। ছুটির দিন রোববার ঘরে আছি, এক ভদ্রলোক এসে হাজির। খোঁজ করলেন আমার নাম করে। আমি এগিয়ে গেলাম। উনি পরিচয় দিয়ে জানালেন, ঢাকা থেকে এসেছেন— নাম শিশির কুমার মজুমদার। পাবলিক রিলেশন্স ডিপার্টমেন্টের চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমাকে বললেন, “আপনি একটা চাকুরীর জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলেন?” আমিতো অবাক। বললাম, দরখাস্ত তো করেছিলাম পাকিস্তানে। উনি জানালেন, চাকুরীটা তাদের ওখানে, ইষ্ট পাকিস্তানে। তারপর তাকে আপ্যায়ন-টাপ্যায়ন করে বিদায় করে দিলাম। ঠিক একমাস পর টেলিগ্রাম। ইন্টারভিউ আমার। নীচে সিগনেচারে নাম জয়নাল আবেদীন। আমি ভাবলাম সেই পেইন্টার জয়নাল আবেদীন। এতবড় পেইন্টার! ইন্টারভিউ হোক আর না হোক যাই উনার সাথে একটু পরিচয় করে আসি। কারণ, তার ছবির প্রতি একটা ফ্যাসিনেশন আগে থেকেই ছিলো। ইন্টারভিউতে গিয়ে দেখলাম যে, উনি নন-এ ভদ্রলোক ডিরেক্টর অব পাবলিক রিলেশন্স, তার নামও জয়নাল আবেদীন। ইন্টারভিউ দিয়ে চলে এলাম, তারপরই চাকুরিতে যোগ দিতে বলা হলো আমায়। এসে দেখলাম, নাজীর আহমদের হাতেই এখানকার ফিল্মস ডিভিশনের দায়িত্ব।
এখানে ছবির কাজ শুরু হলো’ ৫৭ সনে। চারটি ছবি শুরু হয়। ‘আছিয়া’, ‘আকাশ আর মাটি’ এবং আরো দুটো। ‘আছিয়া’তে কাজ শুরু করলাম। ফতেহ লোহানী পরিচালক। নাজীর সাহেবেরই কাহিনী চিত্রনাট্য সব। সবাই ছিলো নতুন, আগে কাজের কোন অভিজ্ঞতা কারও ছিলো না। আমি দেখলাম, এদের সাথে কাজে ঠিক সম্পৃক্ত হতে পারবো ন। কারণ, সবাই ছিলো প্রায় অ্যামেচারিস। অন্যদিকে কলকাতায় ততদিনে আমার ন’বছর কাজের অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে। তবু খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করলাম। এভাবেই শুরু হলো যাত্রা।
আহমেদ: আপনার কলকাতা পর্বের কথা কিছু শোনাবেন আমাদের? কি করে চলচ্চিত্রে এলেন? কাদের সাথে গোড়ার দিকে কাজ করেছিলেন?
ইসলাম: পড়াশুনায় ফাঁকি মারতাম ছোটবেলা থেকেই। মায়ের ইচ্ছে ছিলো ছেলেকে ডাক্তার বানাবেন। কিন্তু থার্ড ডিভিশনে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর মাকে এসে বললাম, রেজাল্ট তো ভীষণ খারাপ করেছি—ডাক্তারিতে চান্স হবে না। মা বললেন যে, অন্তত গ্রাজুয়েশনটা কর।
চলচ্চিত্রে আসার ব্যাপারটা বলতে গেলে এসে যায় বিখ্যাত চিত্র পরিচালক অজয় করের কথা। আগে থেকেই আমাদের পারিবারিক বন্ধুত্ব ছিলো, তাঁর সাথে আমার মামাদের পরিচয় মুর্শিদাবাদে। আমাদের বাড়িতেও নানা অনুষ্ঠানে ঈদ-পার্বনে যাতায়াত ছিলো তাঁর। আমার ছবি আঁকার অভ্যেস ছিলো; সেইটে উনি দেখেছিলেন। আমার মনে হলো অন্য কিছু তো হবে না আমারে দিয়ে, এ লাইনেই ঢুকে যাই। ক্লাস নাইনে থাকতে অবশ্য একবার শুটিং দেখেছিলাম। তবে আনুষ্ঠানিক শুরুটা শ্রী অজয় করের মাধ্যমেই হলো। তাঁকেও বেশ কষ্ট দিয়েছি সে সময়। আমার তখন একটা ক্যামেরা ছিলো। আমি উনাকে দিতাম একটা খালি ক্যাসেট—উনি সেটা লোড করে দিতেন আবার, ছবি এক্সপোজ করে দিয়ে আসতাম তাঁর কাছে: তারপর প্রসেসিং হতো। এই ব্যাপারটায় যে খরচা হতো, তাতেই মায়ের ওপর ভীষণ চাপ পড়তো। উনি তো সামান্য মাইনের চাকুরে ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের স্কুলে। প্রতি মাসে খুব কম করে হলেও তাকে অন্তত ৫ টাকা খরচা করতে হতো আমার ছবির পেছনে। যা ভাবলে এখন অবাক লাগে, কষ্টও পাই খানিকটা। সেই কষ্টটা করতে পারার ফলেই আজ এইখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছি—এর পেছনে আমার মায়ের যেমন অবদান আছে, কর বাবুর কথাও তেমনি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হয় আমাকে।
কলকাতাতে তখন ফিল্মলাইনে মুসলমান হিসেবে চান্স পাওয়াটা খুব ভাগ্যের ব্যাপার ছিলো। মুসলমানরা বরাবর হতো শুটিং ফ্লোরের কার্পেন্টার, বড় জোর মেকআপ ম্যান ছিলো কেউ কেউ। একমাত্র কর বাবুরই কৃতিত্বে বলা যায়, তিনি আমার আগে আরো দুজন মুসলমান ছেলেকে ক্যামেরাম্যান হিসাবে নিয়েছিলেন। একজন রহমান সাহেব এবং দ্বিতীয়জন ছিলেন কে. এ. রেজা। তারপর আমিই হতে পেরেছিলেম একমাত্র মুসলমান ক্যামেরাম্যান।
এইভাবে ১৯৪৭ সনে দেশত্যাগের ঠিক দুদিন পর থেকেই ফিল্ম লাইনে আমার কাজ করা শুরু হলো। মা মারা গেলেন ১৯৫০ সালে। কলকাতা থেকে এরপর অজয় করের সাথেই কাজ করতে চলে গেলাম মাদ্রাজে, তারপর বোম্বেতে—সবসময় উনার সহকারী হিসেবেই গেলাম এখানে সেখানে। আমি একা যাইনি। উনাকে যখন ছেড়ে এলাম, তখন আমি সহকারী থেকে সহযোগী চিত্রগ্রাহকে প্রমোশন পেয়ে গেছি। শেষ দুটো ছবি—‘বড়দিদি’ ও ‘হারানো সুরে’ অবশ্য বেশীরভাগ কাজ আমি করেছিলাম। তবে শেষ দেখে আসতে পারিনি। ‘বড়দিদি’র শেষ দিককার শুটিং বাকি ছিলো। আর ‘হারানো সুর’—যা পরে সুপার হিট হলো, তার টাইটেল শুটিং বাকি রেখেই চলে এলাম এখানে। সেই ‘হারানো সুরে’র খাতিরেই লোকে চেনে আমায়। কিন্তু এ ব্যাপারটাও বেশ খারাপ লাগে আমার। কলকাতায় থাকতে কিন্তু আমার আরো একটা অভ্যেস ছিলো। তখন প্রচুর ছবি দেখতাম। সিনেমা হলে গিয়েই অবশ্য দেখা হতো। এটা ফিল্ম লাইনে ঢোকার পর শুরু হয়। চার বছর টানা এভাবে চালিয়েছি। তখন মাসে গড়ে ১৬টা ছবি দেখতাম; এমনও মাস গেছে, যে মাসে ৩২টা ছবিও দেখেছি। এক হল থেকে বেরিয়েই আরেক হলে ঢুকে যেতাম। কন্টিনিউয়াস চলতে থাকতো এই ছবি দেখা। দুটো দিন পেয়েছিলাম এই চার বছরে, দিনে ৬টা করে ছবিও দেখেছি। সকাল থেকে গভীর রাত অবধি টানা ছবি দেখতে থাকতাম। হিন্দী, বাংলা, ইংরেজী কোন ছবিই বাদ পড়তো ন। তখন নোটসও রাখতাম ছবি সম্পর্কে। ফটোগ্রাফি, কম্পোজিশন, লাইটিংই লক্ষ্য করতাম সবচেয়ে বেশী। সিনেমাহলে এই ছবি দেখাটাই ছিলো আমার ক্লাস; আর টালিগঞ্জে হয় আমার প্রাকটিক্যাল। এখানেই হাতে কলমে শিখেছি সব।
আহমেদ: আপনার কি ধারণা, ‘হারানো সুরে’র মতো ছবি, যেখানে আর্ট ও কমার্সের মিলন ঘটেছে, সে ধরনের ছবি এখন হচ্ছে না কেন?
ইসলাম: এখন সারা পৃথিবীতে কমার্শিয়াল ছবি বলতে বোঝানো হয় নাচ-গান মারপিট; এসব থাকতেই হবে। দুয়েকটা ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলেও হতে পারে। যেমন: ভারতে। সেখানে এতবড় মার্কেট, এত লোক ছবি দেখছে, বছরে ৭০০ ছবি তৈরি হয়; সেদেশেও বড় জোড় ৮/১০টি ছবি খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে এই আর্ট কমার্সের মিলন ঘটেছে। আমাদের এখানে এ ধরণের চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমার ছবিগুলে সবকটাই মার খেয়েছে। কমার্শিয়ালি ফ্লপ হয়েছে বলেই ‘আর্ট ফিল্ম’ হিসেবে এগুলো খ্যাতি পেয়েছে। এইটেই হলো আমার পারসোনাল অ্যাক্সপেরিয়েন্স।
কলকাতা থেকে এখানে এসে চাকুরী নিয়েছিলাম সে কথাতো আগেই বলা হলো। কিছুদিন পর চাকুরীটা ছেড়ে দিয়ে ছবি করার চেষ্টা করতে লাগলাম। একসময় নিজে ছবি করলাম। অন্যের ছবিতে ক্যামেরাম্যান হিসেবে টুকটাক কাজও করতে লাগলাম। এটা বলছি, আমি ততদিনে বিদেশ থেকেও ফিরে এসেছি, তারপরের কথা। ১৯৬৮-তে খান আতাউর রহমানের সাথে ‘সোয়ে নদীয়া জাগে পানি’ নামে একটা ছবিতে কাজ করছি। তাঁর অনেকগুলো ছবিতেই কাজ করেছি। তবে এ ছবিটার কথা বিশেষ করে বলবো এ জন্যে যে, আমার ক্যারিয়ারে যত ছবিতে কাজ করেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফটোগ্রাফীর কাজ করতে পেরেছি এ ছবিতে। এটা খান আতার চতুর্থ ছবি। ছবির কাজ শেষ করার পর ফাইনাল প্রিন্ট করা হয়েছে। একদিন দু‘জনে বসে সেই ছবির প্রিন্ট দেখছি। হঠাৎ করেই সে রেগে গিয়ে বললো, “কি ফটোগ্রাফি করেছো এটা? কি প্রিন্ট করা হয়েছে? এটা কি ফটোগ্রাফি?” আমাকে বলেছেন, “এটা কি শুধু তুমি আর আমি বসে দেখবো? অন্য কেউ দেখবে এ ছবি?” তাঁর মতো পরিচালকও একথা বলতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, ছবির কারেক্ট প্রিন্টও এখানে করা সম্ভব হয় না। যেমন মফঃস্বলে যে প্রিন্ট দেখানো হবে সেখানে কার্বন প্রোজেক্টর নেই, ছবি আরো অন্ধকার লাগবে-সেখানে ছবি তো দেখানোই সম্ভব হবে না। যেমন প্রিন্ট, তেমনি গ্রেডেশন আর প্রোজেকশনও অনেকটা তাই। এই অবস্থাই তো চলছে আজও।
এখন আসল বক্তব্য হচ্ছে, আমরা যেখানে কাজ শিখেছি, সেখানে আজ আর ভালো ফটোগ্রাফির প্রয়োজন নেই। আজকাল ছবি দেখা গেলেই যথেষ্ট। পরিচালকদের কথা, ছবি দেখা গেলেই হলো। ভালো ফটোগ্রাফি যেমন দরকার নেই, তাই আমারও দরকার নেই। আমারও কাজ ফুরিয়ে গেছে। আর এফডিসির অবস্থাও তো চ‚ড়ান্ত খারাপ। এফডিসি ছাড়া ছবি করতে যাবার আর জায়গাও নেই। এর নাম বটে ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন, কিন্তু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোন কার্যকারিতা নেই। কিন্তু ব্যবসায়ও তো কোয়ালিটি মেইনটেইন করতে হয়—সে চেষ্টাও নেই বিন্দুমাত্র। ল্যাব, ক্যামেরা, সাউন্ড সব জায়গাতেই এক অবস্থা, একই কোয়ালিটি। অনেকে বলে যে, কেন এখানে ইন্টারন্যাশনাল মানের ছবি হয় না? হবে কি করে? আসল ব্যাপারটাই তো এখানে কেউ বোঝে না, ভালো ছবি করতে গেলে ভালো ফটোগ্রাফি প্রয়োজন, তারপর অভিনয়ের কথাও এসে যাচ্ছে। ব্যাপারটা যা দাঁড়িয়েছে তা হলো, পুরো ইনডাষ্ট্রিটাই ডোমিনেট করছে আর্টিস্টরা। ছবি ভালো খারাপে তাদের কিছুই যায় আসে না। এদেরকে আর্টিস্টও বলা যায় না, শুধু পারফর্মার; হয়তোবা তা-ও নয়। কোনটাই দরকার হয় না। কারণ যে সব ছবি হচ্ছে তাতে মিনিমাম পারফরমেন্সও দরকার হয় না। এইটেই হচ্ছে বাস্তব অবস্থা। এফডিসির যখন এই অবস্থা, তখন আমাদের অবস্থার আরো অবনতি তো হবেই—সেটা আর বিচিত্র কি?
আহমেদ: কলকাতার কথাগুলো যে ‘নষ্টালজিক’ অনুভূতি’ তার মাঝে সৃষ্টি করেছিলো তা যেন খুব দীর্ঘ হতে পারলো না। বার বারই থামিয়ে দিচ্ছিলেন আমায়। আমিও বারবার চেষ্টা করছিলাম কি করে তার ক্ষোভ, দুঃখকে কিছুটা প্রশমিত করা যায়। তাই এফ.ডি.সি’র কথায় আর না ঘাটিয়ে আবার ষাট দশকেই ফিরে গেলাম। জানতে চাইলাম, ষাট দশকে যখন কাজ শুরু হয়, তখন অবস্থাটা কি ছিলো?
ইসলাম: তখন আমরা এসেছিলাম ভালো কিছু একটা করতে। একটা পবিত্র ব্যাপার বলে মনে হতো। প্রত্যেকটা লোকেরই একটা একনিষ্ঠতা ছিলো কাজের প্রতি। আর এখন আসল ব্যাপারটাই হচ্ছে টাকা। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে আমরা টেকনিশিয়ানরা যে কাজই করতে যাই না কেন—আমরা যাই শুধু কনভেন্স আর ফুডিংয়ের জন্যে। কাজের কোন আগ্রহ আমাদের নেই। টাকা আর ফুডিং- এখন এটাই আমাদের টেকনিশিয়ানদের ব্যাপার। আর শিল্পীরা কি করে? বাজার না বুঝেই দর হাঁকাতে শুরু করে—৫ লাখ, ৭ লাখ। এই তো সেদিনকার অনেক আর্টিস্ট, দুটো ছবি করে একটু নাম করেছে, হিট হয়েছে ছবি; দাম হেঁকে বসে তিন লাখ নেবো। আর আমরা যারা পরিচালক, তারা কি করি? যেহেতু সে পয়সা বেশী চায়- তার ডেট কি করে পাওয়া যাবে, সেই চেষ্টায় মেতে উঠি। কারণ ওরাই তো এখন আমাদের পরিচালক হতে সহায়তা করছে; বানাচ্ছে পরিচালক। আজকাল এটাই হলো পরিস্থিতি। আর ‘৬০ দশকে কি হতো? আমরা পরিচালক ছিলাম, আমরা তৈরি করতাম শিল্পী।
আজকাল ফিন্যান্সের ব্যাপারটা কি রকম হয়েছে? পরিচালককে কি করতে হবে? শিল্পীদের হাত পায়ে ধরে বা যে করেই হোক রাজি করাতে হবে ছবিতে কাজ করতে। যদি তাদের ডেট নেয়া যায়, তবেই টাকা লগ্নীকারী এগিয়ে আসবে এই ছবি প্রোডিউস করতে। আমার হাতেও যদি নামকরা আর্টিস্ট থাকে, যাদের ছবি সো কলড বক্স অফিস হয়েছে—এই ‘সো কলড’ শব্দটা হয়তো আমি রাগে বলছি; কিন্তু এ লাইনে সবাই ওটা মেনে নিয়েছে। তাদের যদি নিতে পারি, তবে কালই আমি ছবি শুরু করতে পারবো। এটাই রিয়েলিটি।
(সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল সিনেমা দর্শনের প্রথম সংখ্যায়।)