ঋত্বিককে প্রতীতির শেষ ভালোবাসা

অর্ণব চক্রবর্ত্তী প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২২, ১১:৫৩ এএম ঋত্বিককে প্রতীতির শেষ ভালোবাসা

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের যমজ বোন প্রতীতি দেবী মারা যান গত ১২ জানুয়ারি ২০২০ তারিখে। ৯৫ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঋত্বিককে নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, নাম “ঋত্বিককে শেষ ভালোবাসা”। সাহিত্য প্রকাশ থেকে প্রতীতি দেবীর ৬৯ পৃষ্ঠার বইটি বেরিয়েছিল ১৯৯৭ সালে।


ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে বোন প্রতীতি দেবীর স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থ 'ঋত্বিককে শেষ ভালোবাসা’ শুধু পারিবারিক স্মৃতির বই নয়, প্রতিভা হিসেবে ঋত্বিকের বেড়ে ওঠার দলিল, পাশাপাশি ইতিহাসেরও এক চকিত বয়ান।

ঋত্বিক ঘটকের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ববাংলার ঢাকায়। ঋত্বিকের জন্মের মাত্র সাত মিনিটের ব্যবধানে পৃথিবীতে আসেন প্রতীতি। বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক ও মা ইন্দুবালা দেবীর নয় ছেলেমেয়ের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন এই দুজন। সুরেশ বাবু আদর করে ঋত্বিককে ডাকতেন 'টেক বাহাদুর' আর প্রতীতিকে 'টুনাই সোনা'। ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন মনীশ ঘটক। সাহিত্যিক মহলে যাঁর পরিচিতি 'যুবনাশ্ব' নামে। দ্বিতীয় ভাই সুধীশ ঘটক। লন্ডন ও জার্মানি থেকে সিনেমাটোগ্রাফি ও টেকনিকালার বিষয়ে  ১৯৩৭ সালে প্রথম উচ্চশিক্ষার ডিগ্রী নিয়ে আসেন। তিনিও 'রামেশ্বর বাগচী' ছদ্মনামে লিখতেন। খুব ভাল গাইতেন। তৃতীয় ভাই আশীষ ঘটক। ছবি তুলতেন, ভালো গাইতেন, সুসংগঠক ছিলেন। চতুর্থ ভাই লোকেশ ঘটক। পেশায় ছিলেন নেভাল কমোডর। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি একাধারে ছবি তুলতে, আঁকতে ও গান গাইতে জানতেন। ইনি ছিলেন ঋত্বিকের শিল্পযাত্রার প্রধানতম অনুপ্রেরণা। বড়বোন তপতী দেবী ছিলেন সুগায়িকা। দ্বিতীয় বোন সম্প্রীতি দেবীও বহুগুণের অধিকারী ছিলেন। তৃতীয় বোন ব্রততী দেবী নাচে, গানে ও সাংগঠনিক দক্ষতায় পারদর্শী ছিলেন। ঋত্বিক জন্মেছিলেন এমন পরিবারে, যা তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গের উচ্চশিক্ষিত পরিবারগুলোর মধ্যে ছিলো অন্যতম।

প্রতীতি দেবী লিখেছেন, “আমাদের এমনই একটি পরিবার, যেখানে শিক্ষা ও সংস্কৃতি ছিল উঁচুদরের।” যে পরিবারে গান বা নাটকের আয়োজন হতো নিয়মিত। পরিবারের সদস্যরাই সেখানে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯২৬ সালে ২নং  হৃষিকেষ দাস রোডের বাড়িটিতে (ঝুলন বাড়ি নামে খ্যাতি ছিল) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এসেছিলেন। সুরেশ বাবুর আতিথেয়তায় রবীন্দ্রনাথের ঐ বাড়িতে অবস্থানের স্মৃতিস্মারক ছবিটি এখনও ঢাকার বলধা গার্ডেনে (ওয়ারী) সংরক্ষিত আছে। এ পরিবারে সমসাময়িক আরো অনেক গুণীজনদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল।

গ্রন্থটিতে প্রতীতি দেবী আমাদের জানান, ঋত্বিক-প্রতীতির জীবনে একজন মিস হগ্্বেনের ভূমিকা। ছোটবেলায় ময়মনসিংহের দিনগুলিতে ঋত্বিক-প্রতীতিকে মিশনারি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল। আর সেই স্কুলেরই প্রিন্সিপাল ছিলেন মিস হগ্্বেন। ঋত্বিক-প্রতীতি ভীষণ দুষ্টু ছিলেন ছেলেবেলায়। তাই তাঁদের মা-বাবা শুরুর দিনগুলোতে স্কুলে পাঠিয়েও ভীষণ দুশ্চিন্তায় থাকতেন! কিন্তু, মিস হগ্্বেন নিজের সন্তানের মত পরম মমতায় এই দুষ্টু বাচ্চা দুটিকে আগলে রাখতেন। ভদ্রমহিলা আদর করে ঋত্বিক ও প্রতীতিকে যথাক্রমে রিট (Rit)ও প্রিট (Prit) নামে ডাকতেন।  

ময়মনসিংহে একবার ভীষণ ঘূর্ণিঝড় হলে সুরেশ বাবুকে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যেতে হয়েছিল এবং ইন্দুবালা দেবী দূর্গতদের সাহায্যার্থে ক্ষণস্থায়ী হাসপাতাল খুলে সেবাকার্য পরিচালনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তখন মিস হগ্‌বেন তাঁর প্রিয় রিট ও প্রিটের সার্বক্ষণিক দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সে সময়কার কথা স্মরণ করে প্রতীতি দেবী লিখেছেন, “সে সময় কিছুদিনের জন্য মিস হগ্‌বেনকে আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। তখন তিনি প্রতিদিনের সাথী। রাতে শোবার সময় আদর করে শুইয়ে দিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প আর গান করে সব শেষে তিনি বলতেন, “Whatever you do, do with your mind.”

জীবনে এই শেষ কথাটির গুরুত্ব বোঝাতে প্রতীতি দেবী আরো লিখেছেন, “আজো প্রতি রাতে তাঁকে স্মরণ করে কথাটি মনে করি। যা করি, মন দিয়েই করি। যা করি না, সেটা কখনোই করি না। কোনো আপস-মীমাংসার প্রশ্ন নেই। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ঋত্বিককে করেছে সফল। আমাকে করেছে মানসিক শক্তির অধিকারী। শত কোটি প্রণাম তাঁর পায়ে।”

প্রতীতি তাঁর বিখ্যাত ভাইটি সম্পর্কে আমাদের বলেন,  যে মানুষ সভ্যতার জয়রথকে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে নিয়ে গেছে সেই দরিদ্র-নিপীড়িত সাধারণ মানুষই ছিল ঋত্বিক প্রতিভার প্রধান অনুপ্রেরণা। ঋত্বিক যখন সবেমাত্র তাঁর কৈশোরে পদার্পণ করেছেন, ঠিক তখন থেকেই তাঁর নিগৃহীত মানবতার প্রতি ভালোবাসার দিকটি ফুটে উঠতে দেখি। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে পড়ার সময় একবার ঋত্বিক প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন। এ কারণে পরিবারের অগ্রজদের পরামর্শে তাঁকে সাধারণ পাঠ্যক্রমের পরিবর্তে কানপুরের একটি টেকনিক্যাল স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়েছিল কিছুদিনের জন্য। তখন কানপুর ছিল একটি শিল্প এলাকা। অত কম বয়সেই ঋত্বিক শ্রমিক জীবনের সংস্পর্শে এসে অমানুষিক শ্রম ও শোষণের স্বরূপটিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সেখানে প্রায় ১৮ ঘন্টা শ্রমিকদের খাটানো হত। ঋত্বিক এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগঠিত করবার চেষ্টা শুরু করেছিলেন। কিন্তু, দিনকয়েক পরই ঋত্বিককে আবার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনা হয়। তখন চারিদিকে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের ডামাডোল। অবশ্য ১৯৪৬ সালের আগেই ঋত্বিকের পরিবার কলকাতা চলে যান। ছেচল্লিশের দাঙ্গা শুরু হলে ঋত্বিক ঘটক চলে যান দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায়, সেখানে তিনি আরো অনেকের সাথে পালাক্রমে মুসলমান ও হিন্দু এলাকায় ঘরে ঘরে পাহারা দেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় প্রচুর শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিলে, ঋত্বিক এই আক্রান্ত মানবতার জন্য সাধ্যের সবটুকু  উজাড় করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একবার সর্বনিম্ন বেতন কাঠামোর দাবিতে শ্রমিকদের সাথে সরকারের বাক-বিতণ্ডা শুরু হলে, ঋত্বিক সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেন। তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডা. বিধানচন্দ্র রায়। একই আন্দোলনে ছিলেন ঋত্বিকের দ্বিতীয় দাদা সুধীশ ঘটক। যিনি ঋত্বিকের আপোষহীন মনোভাব দেখে সুর নরম করতে বলায়, সবার সামনেই ঋত্বিক তাঁর সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হন এবং শ্রমিকদের দাবির পক্ষে অনড় অবস্থান নেন। কিছুদিন পর স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর পিএ ঋত্বিককে ফোন করেন এবং মুখ্যমন্ত্রীর তাঁর সাথে কথা বলবার ইচ্ছার কথা জানালে সোজাসুজি নাকচ করে দেন। শ্রমিকদের দাবির ব্যপারে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতেও রাজি হননি তিনি। নিজের বিশ্বাস ও আদর্শের প্রশ্নে আজীবনই তিনি ছিলেন অবিচল। ঋত্বিক নির্মিত প্রথম ছবি 'নাগরিক'। যখন এ ছবি তৈরি হয় তখন ঋত্বিকের বয়স খুব কম। তাঁর এ ছবির অর্থায়ন করেছিলেন পরিবারের লোকজন সবাই মিলে। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার বিষয় এই যে ছবিটি তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রবল অসহযোগিতার কারণে মুক্তি পায়নি। বিশ্লেষকদের ধারণা, এ ছবিটি যদি সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র আগে মুক্তি পেতো তাহলে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস ভিন্নরকম হতো। সত্যজিৎ রায় নিজেও বলেছিলেন, “তখন যদি ওই ছবি (নাগরিক) দেখানো হতো, তাহলে ঋত্বিকের আগে ভারতবর্ষে আর কারো নাম উচ্চারিত হতো না।”

ঋত্বিকের পরের ছবি 'অযান্ত্রিক', যা গুণীজনদেও প্রশংসা কাড়ে ও কিছু মাত্রায় ব্যবসাসফল হয়। এরপরে তিনি শিবরাম চক্রবর্তীর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’কে সেলুলয়েডে রূপান্তর করেন। ঋত্বিকের পরবর্তী ছবি 'মেঘে ঢাকা তারা'। এ ছবিতে ঋত্বিক প্রত্যক্ষভাবে নিয়ে আসেন শরণার্থী ও উদ্বাস্তু জীবন। এ ছবি যখন মুক্তি পায় তখন প্রতীতি কলকাতায় গিয়েছিলেন। তিনি ঋত্বিকসহ ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে বসে  দেখেছিলেন। সে অনুভূতির কথা প্রতীতি দেবী লিখেছেন, “শেষ হবার পর দর্শক যাঁরা বেরিয়ে আসছেন, সবাইকে দেখলাম তাদের চোখ-মুখ ফোলা। ও (ঋত্বিক) জিজ্ঞেস করলো, ‘মশাই কেমন দেখলেন ছবি?’ হলের মালিক এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন, ‘ইনিই এ ছবির নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক।’ হল ভর্তি লোক হুমড়ি খেয়ে পায়ে পড়তে চায়। ঋত্বিক জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘আমার জীবন-সত্তা আপনারা, আমার প্রাণের দেবতা আপনারা। আপনাদের জন্যই আমার জন্ম।’ তাদের রুমাল আঙুলে জড়িয়ে ঝাণ্ডা তৈরী করে জয় জয়কার করতে করতে পথে নেমে গেলেন জনতা।”

ঋত্বিক এরপরে করেন 'সুবর্ণরেখা' ছবিটি। সে ছবির 'সীতা' চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন মাধবী মুখার্জী। আর মাধবী মুখার্জীকে ঋত্বিক নিয়েছিলেন প্রতীতি দেবীর মতামতের উপর ভিত্তি করে। মাধবী মুখার্জী তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বরিশালের মানুষ ছিলেন। দেশভাগের পর তিনি ও তাঁর মা শরণার্থী হিসেবে কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। শরণার্থী-উদ্বাস্তু জীবনের নির্মম বাস্তবতার সাথে প্রত্যক্ষ পরিচিতির কারণে প্রতীতি দেবী এই চরিত্রের জন্য মাধবী মুখার্জীকে নির্বাচন করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ঋত্বিক প্রথমবারের মত বাংলাদেশে আসেন। সেবার তিনি প্রতীতি দেবীর সাথে ঢাকা হয়ে কুমিল্লায় নিজেদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়েই ঋত্বিক ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ বইটি প্রথমবারের মত হাতে পান। প্রতীতিই সেটা দেন ঋত্বিককে। বইটি পাঠান্তে এতটাই মুগ্ধ হন ঋত্বিক, উপন্যাসকে সেলুলয়েডে রূপান্তরের ব্যপারে মনস্থির করে ফেলেন। বইটি মাঝরাত্তিরে পড়া শেষ হলে তিনি তখনই স্ক্রিপ্ট লিখবেন বলে প্রতীতি দেবীর কাছে কাগজ-কলম চেয়ে বসেন। কিন্তু বাসায় কাগজ না থাকায় ঋত্বিক প্রতীতি দেবীর হাতের উপরে লিখতে শুরু করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে প্রতীতি দেবী তাঁর ইস্ত্রি করা একটি সাদা কাপড় বের করে দেন এবং তাতেই লিখিত হয় 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছবির স্ক্রিপ্ট।

আলোচিত গ্রন্থে, তৎকালীন পূর্ববাংলার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে নতুন করে আবিষ্কার করি। তিনিই প্রথম মানুষ যিনি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু-ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকে ব্যবহারের ভাষা করার দাবি তুলেছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বড় ছেলে সঞ্জীব দত্তের সঙ্গে প্রতীতি দেবীর বিয়ের মধ্য দিয়ে দুই বিখ্যাত পরিবারে আত্মীয়তার মেলবন্ধন স্থাপিত হয়। করাচিতে একবার পরিষদ অধিবেশনে কথা উঠেছিল যে,ধীরেন বাবুর পরিবারের লোকজন কেউ পাকিস্তানে থাকেন না। এতে দেশ-অন্তঃপ্রাণ ধীরেন্দ্রনাথের মর্যাদাবোধে ভীষণ আঘাত লেগেছিল! তিনি রি-প্যাট্রিয়েশন করিয়ে, ১৯৫৩ সালের ১৫ মার্চ পুত্রবধূ (প্রতীতি) এবং নাতনি আরোমাকে পূর্ববঙ্গে নিয়ে আসেন। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হলে, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধ শিবিরে অবস্থান নেন। তখন তাঁকে একবার জেলে বন্দী করা হয়। পরবর্তীকালে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে, দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার আদেশ জারি হয়, কিন্তু তখন আবার কুমিল্লার জেলা প্রশাসক ছিলেন আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ্। তিনি ধীরেন বাবুর  স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে এ আদেশ বাতিল করে দেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিতে ধীরেন বাবুর মানসিক অবস্থা বর্ণনা করে প্রতীতি দেবী লিখেছেন, “সমগ্র বাড়িটাই জেলখানা। সেবার মানসিকভাবে উনি খুবই ভেঙে পড়েছিলেন, যে দেশের জন্য জীবনপণ করে কাজ করে গেছেন, সমগ্র জনগণের হৃদয়ে যাঁর স্থান এবং তাঁর হৃদয়ে মননে ও মনে সমস্ত দরিদ্র জনগণ, সেই তারই কি না এই বন্দিদশা।”

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে পতন হয়েছিল আইয়ুবী স্বৈরাচারের, আর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে এদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা আরো তীব্র রূপ লাভ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিতে নিরীহ বাংলাদেশীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ঐ রাতেই ঢাকায় জান্তা কর্তৃক গণহত্যা শুরুর খবর পাশের বাড়ির একজন জানালে এবং কুমিল্লা শহরে তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা শহর ছেড়ে যাবার অনুরোধ করলে ধীরেন্দ্রনাথ সাহসী প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, “আমি গেলে পূর্ববঙ্গের সব মানুষের বিপদ বাড়বে, বহু লোককে ওরা হত্যা করবে।”

এদেশের মানুষকে ভালোবেসে নিশ্চিত মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ  দিবাগত রাতে পাক হানাদাররা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও তাঁর ছোট ছেলে দিলীপ দত্তকে মেরে ফেলে। তার ভয়াবহ বর্ণনা প্রতীতি দিয়েছেন এই বইতে। তাই বলা যায়, এই বইটি একাধারে ঋত্বিক, প্রতীতি, ধীরেন্দ্রনাথ, পূর্ববঙ্গ ও বাংলাদেশের কথা বলেছে।

পরিশেষে বলবার এই যে, ঋত্বিককে নিয়ে এ যাবৎকালে অনেকেই লিখেছেন কিন্তু ক্ষীণতনুর এই বইতে যমজ বোন (ঋত্বিকের ভাষায় ‘ইটার্নাল পেয়ার’) প্রতীতি দেবী যতটা জীবন্তভাবে হাজির করতে পেরেছেন তা সত্যি প্রণিধানযোগ্য। বইটি আরো বেশি পাঠক লাভ করুক সেটাই চাই।

(লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয় সিনেমা দর্শনের প্রথম সংখ্যায় (২০২০)।)