চলচ্চিত্র বিচার

ভাবনাকে উসকে দেওয়া বই

ফাহিম ইবনে সারওয়ার প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২২, ০৬:৩৮ পিএম ভাবনাকে উসকে দেওয়া বই

চলচ্চিত্র বিষয়ক বই আমাদের বাংলায় অপ্রতুল। সেই প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র সমালোচনাকে দুর্লভ-ই বলতে হয়। অল্প যে-কজন মানুষ একেবারেই ভেতরের তাড়না থেকে চলচ্চিত্র নিয়ে বাংলায় ভালো লেখেন, বিধান রিবেরু সেই দলের মধ্যে একজন।

তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধের বই—’চলচ্চিত্র বিচার’। যথারীতি সীমিত পরিসরে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন মেধাবী এই প্রবন্ধকার। চারটি অধ্যায়ে মোট ২৪টি প্রবন্ধ ঠাঁই পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্রসহ সর্বোপরি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিচার, বিদেশি চলচ্চিত্র বিচার, সংস্কৃতি কারখানা বিচার—এই চারভাগে আলোচনা করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বিচারে আটটি প্রবন্ধে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করা হয়েছে। সমসাময়িক এবং মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নিয়ে একসাথে এরকম আলোচনা পাঠকের ভাবনার জগতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—প্রবন্ধ দুটি ঐতিহাসিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। প্রবন্ধ দুটির সচেতন পাঠ অনিবার্য।

প্রবন্ধকার বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এমন অনেক জায়গা সচেতনভাবে ছুঁয়ে গেছেন যেখানে কেউ বুঝে শুনেই কখনো আঙুল বোলায়নি। বিশেষত হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র। হুমায়ূনের টিভি নাটক বা উপন্যাস নিয়ে যতটা আলোচনা হয়েছে, সেরকমভাবে আলোচনায় আসেনি তাঁর চলচ্চিত্র। তাছাড়া হুমায়ূনের অসম্ভব জনপ্রিয়তা, সমালোচক মহলে তাঁকে অগুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে, বিশেষ করে চলচ্চিত্র নির্মাতা পরিচয়টিকে। এই বইয়ে হুমায়ূনের চলচ্চিত্র নিয়ে লেখা, ‘হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র : নতুন কী বলেছেন’—লেখাটা চলচ্চিত্রের হুমায়ূনকে আমাদের সামনে নিয়ে এসেছে। ‘আগুনের পরশমণি’ এবং ‘শ্যামল ছায়া’ চলচ্চিত্র দুটি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই প্রবন্ধে। শ্যামল ছায়া চলচ্চিত্রের আলোচনায় লেখকের বিচার-বিশ্লেষণ বোদ্ধা পাঠককের দৃষ্টি অনিবার্যভাবেই আকর্ষণ করবে, ‘শ্যামল ছায়াতে আরেকটি নতুন কথা বলার চেষ্টা করলেন হুমায়ূন আহমেদ। সেটা হলো টুপি দাড়ি রাখা মৌলবি মানেই খারাপ বা নেতিবাচক চরিত্র নয়। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে স্টেরিওটাইপ হয়ে যাওয়া রাজাকারদের চেহারা ভেঙে দিতে চাইলেন হুমায়ূন। সেই স্টেরিওটাইপকে শুধু ভাঙেননি তাকে দিয়ে বন্দুক ধরিয়েছেন পাকসেনাদের বিরুদ্ধে’। (পৃষ্ঠা ৮৮; হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র : নতুন কী বলেছেন)

মেহেরজান এবং গেরিলা চলচ্চিত্র দুটি নিয়ে রয়েছে পৃথক দুটি আলোচনা। দুটি চলচ্চিত্রই এখনো সামপ্রতিক। একটি ভীষণভাবে ‘গ্রহণীয়’ এবং ‘পুরস্কৃত’ আরেকটি ‘নিষিদ্ধ’ এবং ‘প্রত্যাখ্যাত’। এর বাইরে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতার সর্বশেষ চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নির্মাতা তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র রানওয়ে।

বিদেশি চলচ্চিত্রের বিচার বিভাগে সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্মাতাই পশ্চিমবঙ্গের। আলোচনায় এসেছেন সত্যজিত্ রায়, ঋত্বিক ঘটক, গৌতম ঘোষ। প্রসঙ্গত এসেছেন রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ এবং লালন। সত্যজিত্ এবং ঋত্বিকই বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন। বিশেষ করে ধার করা গল্প নিয়ে নির্মিত সত্যজিতের দুই ছবি ‘পথের পাঁচালী’ (বিভূতিভূষণের প্রথম উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত) এবং রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প পোস্টমাস্টার নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘পোস্টমাস্টার’। যারা একই সাথে সাহিত্যের পাঠক এবং চলচ্চিত্রের দর্শক তাদের জন্য প্রবন্ধ দুটি গ্রহণীয় এবং উপভোগ্য হবে। কারণ, উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র নিয়ে ‘অতিক্রম’ করার যে বিতর্ক বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান, সেখানে নির্মোহ আলোচনা করেছেন প্রবন্ধকার। সত্যজিতের দুটো চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তিনি লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘পোস্টমাস্টার’ থেকে সত্যজিত্ রায় যে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তা শুদ্ধ নির্মাণ নয়, বিনির্মাণ বটে। রবীন্দ্রনাথের গল্পে কী নেই আর সত্যজিতের ছবিতে কী আছে এবং তার উল্টো হিসাবটা মেলালেই রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে যাওয়া সত্যজিেক চোখে পড়বে বৈকি। সেই অর্থে চলচ্চিত্র ‘পোস্টমাস্টার’ নতুন সৃষ্টি, সফল বির্নিমিত চলচ্চিত্র’। (পৃষ্ঠা ৯৫; রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার : সত্যজিতের রাজনৈতিক আখ্যান)

ঋত্বিক ঘটক এবং তাঁর সিনেমা নিয়ে লেখা দুটি প্রবন্ধই ভাবিয়ে তুলবে পাঠককে। অন্যদের তুলনায় কম কাজ করলেও এই নির্মাতা কদর পেয়েছেন অন্যদের চেয়ে বেশি। বিশেষ করে দেশভাগের বিষয়টি ঋত্বিককে সারাজীবন তাড়িয়ে বেরিয়েছে। সে ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব মতামতও ছিল। দেশভাগ, গণনাট্য, রাজনীতি ঋত্বিকের সিনেমায় বারবার ফিরে এসেছে। তাঁর ছবি, তাঁর সময়ে আলোচনা তৈরি করতে না পারার ‘আক্ষেপ’ ঋত্বিককে ভুগিয়েছেও বেশ। ঋত্বিক প্রসঙ্গেও এসেছে বিনির্মাণের আলোচনা। ঋত্বিকের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘অযান্ত্রিক’ তৈরি হয়েছিল সুবোধ ঘোষের একই নামের প্রথম ছোটগল্প অবলম্বনে। প্রসঙ্গত এখানে এসেছে বিশ্বচলচ্চিত্রের দিকপাল রাশিয়ান সার্গেই আইজেনস্টাইনের কথা। ঋত্বিক, যাঁর ভাবশিষ্য।

সামপ্রতিক কলকাতার নির্মাতাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ গৌতম ঘোষের ছবি ‘মনের মানুষ’ নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন প্রাবন্ধিক। লালনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিয়ে যে সচেতনতা প্রকাশের দরকার ছিল, তার ঘাটতি ছিল গৌতমের প্রয়াসে। এমনটাই বক্তব্য প্রাবন্ধিকের।

এসবের বাইরে সময়োপযোগী আরো কিছু লেখা রয়েছে। বইটিতে ছাপা হওয়া প্রায় সব লেখাই আগে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত। তাই প্রবন্ধের সময় এবং প্রেক্ষাপট সম্পর্কে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হবে। রয়েছে রেফারেন্সের দীর্ঘ তালিকা। পড়ুয়া পাঠককে আগ্রহ বাড়িয়ে দেবার মতো সবকিছুই রয়েছে ‘চলচ্চিত্র বিচার’ বইতে। শুভ সুখপাঠ!

 

চলচ্চিত্র বিচার

বিধান রিবেরু 

প্রচ্ছদ :আকরাম রতন 

প্রকাশক :কথাপ্রকাশ 

মূল্য :১৬০ টাকা

( লেখাটি প্রথম প্রকাশ হয় দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকির ৩১ জানুয়ারি ২০১৪ সালের সংখ্যায়। )