বইটি শুরু হয়েছে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় আর কুমার সাহানির আলাপ দিয়ে। এরপর যোগ হয়েছে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের লেখা: ঋত্বিক উপাখ্যান। বইটি পাঠের প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে বলে রাখা ভালো সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন ঋত্বিককে নিয়ে। যেমন ঋত্বিকের রচনা সংগ্রহ ‘চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু’ শিরোনামের বইটির লেখা সংগ্রহ ও ভূমিকা লিখেছেন তিনি। এছাড়া ‘ঋত্বিকতন্ত্র’ নামে তাঁর একটি বহুল পঠিত বইও রয়েছে। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, প্রায় চার দশক ধরে তিনি ঋত্বিকচর্চা করে আসছেন।
অন্যদিকে কুমার সাহানি ভারতের প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক ও ঋত্বিকের সরাসরি ছাত্র। পুনে ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের প্রাক্তন এই ছাত্র ভারতের চলচ্চিত্র ইতিহাসে নিজের নাম যুক্ত করে নেন- প্রথম ফর্মালিস্ট ধারার ছবি ‘মায়া দর্পন’ (১৯৭২) নির্মাণ করে। ঋত্বিক ছাড়াও ডি.ডি. কোশাম্বির ছা্ত্র তিনি। ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে গেছেন প্যারিসে। সেখানে কাজ করেছেন বিখ্যাত পরিচালক রবার্ট ব্রেসঁর সাথে।
‘ঋত্বিক উপনিবেশ’ বইটি শুরু হয় সঞ্জয় ও কুমারের আলাপ দিয়ে। বিষয় ঋত্বিক কুমার ঘটক। দুটি বিষয় মোটা দাগে উঠে আসে এই আলোচনায়। এক: ঋত্বিক ঘটককে সমসাময়িক রাজনৈতিক কমরেডদের অনেকেই বুঝতে পারেননি। এজন্য তাঁর মনোকষ্ট ছিলো। আর দুই: ঋত্বিকের মতো করে চলচ্চিত্রে শব্দের ব্যবহার ভারতের কোন চলচ্চিত্র নির্মাতা আগে করেননি। কুমার সাহানি এক জায়গায় বলছেন, কমিউনিস্ট পার্টির অন্যান্যদের কাছ থেকে যখন ‘কোমল গান্ধার’ নিয়ে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছিলেন না, তখন সিপিআই নেতা পিসি জোশি একমাত্র মানুষ যিনি ‘কোমল গান্ধার’ দেখে প্রশংসা করেন। ঋত্বিক তখন তাঁর স্ত্রী সুরমাকে চিঠিতে লেখেন, ‘জোশি আমায় চুমু খেয়ে বলেছে, আমি ভারতের একমাত্র গণশিল্পী, আমার আর কী চাই?’
কার্ল মার্ক্স বলতেন, শিল্পসংক্রান্ত যে কোন কাজ আসলে আধ্যাত্মবাদের কাজ। কোনও রকম যা-তা কাজ নয়। একটা আধ্যাত্মিক চেতনার মতো করেই ধরা হয় শিল্পকে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ। সিনেমাকে বাস্তবের হাত থেকে উদ্ধার করে বস্তুনিরপেক্ষতায় নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে মার্ক্সকে এভাবেই উদ্ধার করেন কুমার সাহানি। মার্ক্স যেভাবে শিল্পকে এখানে দেখেছেন, সেটার থেকে খুব একটা ভিন্নভাবে দেখেননি ঋত্বিক। তিনিও বিষয়টিকে ধ্যানজ্ঞানের বস্তুই করে তুলেছিলেন। তাই একের পর এক বাধা সত্ত্বেও চলচ্চিত্র নির্মাণ করে গেছেন।
দ্বিতীয় পর্বে, অনেকটা স্মৃতিচারণ ও মূল্যায়নধর্মী লেখায় সঞ্জয় স্মরণ করেন ঋত্বিককে, যেখানে ঋত্বিকের চলচ্চিত্র নিয়ে যেমন আলাপ আছে, তেমনি আছে ব্যক্তি ঋত্বিককে স্মরণ। এক জায়গায় সঞ্জয় বলছেন, উনারা একবার জাপানি ছবির উৎসবে যাচ্ছিলেন। তখন ঋত্বিক তাঁদের বলেছিলেন, ‘মিজোগুচি দেখো, মিজোগুচি দেখো। এক্সপোর্ট কোয়ালিটি জাপান নয়, রিয়েল জাপান।’ আরেক জায়গায় দেখা যায় ঋত্বিক পান করে চলেছেন, যক্ষ্মা থাকার পরও। অন্যরাও তাঁকে সঙ্গ দিয়েছেন সমান তালে। সেই পানের উৎসবে সঞ্জয় ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ফরাসি ভাষাবিদ নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। ঋত্বিক যক্ষ্মার মতো রোগে আক্রান্ত জেনেও সঞ্জয় ও নারায়ণ একই গ্লাসে চুমুক দিতে দ্বিধা করেননি, কারণ ওসব রোগটোগের চেয়েও ঋত্বিকের সান্নিধ্যই তাঁদের কাছে ছিলো পরম পাওয়া, তাই অভিন্ন পাত্র থেকে সুধাপান চলেছে নির্দ্বিধায়।
এই মদ খাওয়া প্রসঙ্গেই সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় বলছেন ভিন্ন জায়গায়, ‘ঋত্বিকের মত মদ খেতে পারি, কিন্তু দশ কোটি টাকা দিলেও একটা ‘কোমলগান্ধার’ বা ‘সুবর্ণরেখা’ বানাতে পারবো না।”
বইটিতে আরেকটি বিষয়ের উপর সঞ্জয় আলোকপাত করেছেন। সেটি হলো ঋত্বিক তাঁর সমগ্র কাজেই মানুষের ইতিহাস, সাধারণ মানুষ, যারা প্রান্তিক বলে পরিচিত, তাদেরকে যুক্ত করে গল্প বলার চেষ্টা করেছেন। তাই সঞ্জয় বলছেন, ‘ঋত্বিক সারা জীবনই মাতৃভূমির মধ্যে একটা ইতিহাস খুঁজতে চেয়েছেন’, এবং সেই ইতিহাস কোন চাপিয়ে দেয়া ইতিহাস নয়, সে এমন এক ইতিহাস, যেখানে এই ভূখণ্ডের আদিবাসীদের কথাও থাকে, আর থাকে ইতিহাসের ভুল ও বেদনা।
ক্ষীণতনুর ‘ঋত্বিক উপনিবেশ’ বইটি বেরিয়েছে কলকাতার ‘খোয়াবনামা’ থেকে, ২০১৬ সালে।