চলচ্চিত্রকার সের্গেই পারাজানভ: নৈঃশব্দ্যের নির্মাতা

আলম খোরশেদ প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১, ২০২৩, ০৪:৫৭ পিএম চলচ্চিত্রকার সের্গেই পারাজানভ: নৈঃশব্দ্যের নির্মাতা
সের্গেই পারাজানভ

বছর পঁয়ত্রিশেক আগে ম্যানহাটানস্থ নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির মিডিয়া সেন্টারে বসে আট মি.মি. প্রজেক্টর চালিয়ে ছোট এক অন্ধকার কুঠুরির সাদা দেওয়ালে আশ্চর্য এক আলোর সন্ধান পেয়েছিলাম। সে আলোর উৎস Shadow of the Forgotten Ancestor নামে একটি অত্যাশ্চর্য চলচ্চিত্র। তারই স্রষ্টা সুবিখ্যাত আর্মেনিয়ান পরিচালক সের্গেই পারাজানভ (১৯২৪-১৯৯০), যাঁকে শিরোনামে ‘নৈঃশব্দ্যের নির্মাতা’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই স্বীকারোক্তি অবশ্য সের্গেইয়ের নিজেরই। ফিল্ম কমেন্ট পত্রিকার মে-জুন ১৯৮৯ সংখ্যার একটি লেখায় সের্গেই বলেন, ‘‘আমার মতে সেই ছবিই সত্যিকারের চলচ্চিত্র, যা তৈরি হবে বোবা-কালাদের জন্য। আমরা বড় বেশি কথা বলি; এত কথা, এত কথা! একমাত্র ব্যালেতেই দেখি বিশুদ্ধ সৌন্দর্য, খাঁটি মূকাভিনয়। আমার আরাধ্য তা-ই।” 

উল্লিখিত ছবিতে যেন সেই নৈঃশব্দ্যের সৌন্দর্যকেই খুঁজে পেয়েছিলাম। অবশ্য সেই সঙ্গে ছিল রঙের ভুরিভোজ। আর ক্যামেরার ঐন্দ্রজালিক কারুকাজ। তো এহেন আনকোরা নতুন রীতির ও মৌলিক বৈশিষ্ট্যের একজন পরিচালককে আবিষ্কার করার পর তাঁর অন্য ছবিগুলো দেখার প্রত্যাশা ছিল। সে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছিল পরে নেউ ইয়র্কের বাঙালিপাড়া বলে কথিত অ্যাস্টোরিয়ায় অবস্থিত ‘ম্যুজিয়াম অফ দ্য মুভিং ইমেজ’ তথা MOMI র সৌজন্যে। তারা ১৯৯০ সালে প্রয়াত এই মহান পরিচালকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসাবে আয়োজন করেছিল তাঁর সবক’টি ছবির প্রদর্শনী। সংখ্যায় অবশ্য বেশি নয়, সাকুল্যে আটখানা ছবি। তার মধ্যে প্রথম পর্যায়ের শিক্ষানবিশি কাজ চারখানা, আর বাকি চারটি পরবর্তীকালের পাকা হাতের কাজ, যা তাঁকে এনে দিয়েছিল বিশ্বজোড়া সুনাম। স্বদেশী সোভিয়েত ইউনিয়নের আরেক মহান শিল্পী ও বিশুদ্ধ চলচ্চিত্রকার আন্দ্রেই তারকোভস্কি পর্যন্ত তাঁকে জিনিয়াস আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘চলচ্চিত্রে সত্যিকারের জিনিয়াস আছেন অল্প ক’জনই। ব্রেসোঁ, মিজোগুচি, দভঝেঙ্কো, পারাজানভ, বুনুয়েল; এঁদের একজনকেও অন্যজনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার কোন উপায় নেই।” সেই উৎসবে পারাজানভের দু’খানা ছবি দেখার সুযোগ করে উঠতে পেরেছিলাম। একটি তাঁর প্রথম দিককার ছবি Flower on the Rock এবং অন্যটি তাঁর সর্বশেষ নির্মাণ, ১৯৮৮ সালে বানানো Ashik Karib । প্রথম ছবিটি একটু প্রচারধর্মী হলেও নির্মাণকৌশলের মুন্সিয়ানায় শেষপর্যন্ত উপভোগ্য হয়ে ওঠে। তবে মুগ্ধ ও বিস্মিত হতে হয় অপর ছবিটি, যা তাঁর সর্বশেষও বটে, দেখে।

Ashik Karib মধ্যএশিয়ার এক প্রাচীন চারণ কবির নাম। তাঁর জীবন, প্রেম ও বিদ্রোহই যার প্রধান প্রণোদনা, নিয়েই এই ছবি। কিন্তু প্রথাসম্মত সরলরৈখিক ন্যারেটিভের আশ্রয় না নিয়ে সের্গেই এ ক্ষেত্রে বেছে নেন আশিকের এক দীর্ঘ প্রবজ্যাকে। পরিচালকের কুশলী ক্যামেরা অনুসরণ করে প্রেমাস্পদাকে পাবার প্রেরণায় স্বেচ্ছায় বরণ করে নেওয়া আশিকের সেই দুরূহ পর্যটনের প্রতিটি পর্যায়কে। আর এই পথপরিক্রমায় পারাজানভ ইচ্ছামতো দেশকালের ধারাবাহিকতাকে ভাঙচুর করে, আশিকের জীবনকাহিনি পরিবেশনের ছলে আমাদের উপহার দেন, সাধারণ মানুষের জীবন ও সংস্কৃতি এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের নিজস্ব সংগ্রামের এক জাদুবাস্তব উপাখ্যান। সের্গেইর ছবিতে কথার পরিমাণ খুবই কম থাকে। বস্তুত বিশাল প্রাকৃতিক পটভূমিতে অজস্র, অভাবনীয় রংয়ের প্রান্তরে অখণ্ড নীরবতায় একের পর এক আশ্চর্য ইমেজ ও প্রগাঢ় প্রতীকের প্রবাহই তাঁর ছবির মূল বৈশিষ্ট্য। এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। তবে এক্ষেত্রে মূল চরিত্রের চারণকবি সত্তার সুযোগ নিয়ে সের্গেই তাঁর ছবির নিপাট নৈঃশব্দ্যকে মাঝেমধ্যে যেন ইচ্ছা করেই, ভেঙে দেন লোকগান আর গ্রামীণ নৃত্যের সশব্দ সমারোহে। অবিস্মরণীয় সুর, আর অত্যাশ্চর্য সব ভঙ্গি ও বিন্যাস সেই যৌথ নাচের। এরই মাঝে সের্গেই কোলাজের মতো করে সেঁটে দেন প্রায় পরাবাস্তব কিছু চিত্র। ঝর্নার ধারে মাছ ধরার উৎসব, কী উন্মুক্ত প্রান্তরে অন্ধ দম্পতির বিবাহ অনুষ্ঠান, এমনিতরো কাব্যময় দৃশ্যাবলি, সেই সঙ্গে তাঁর ক্যামেরা অবিশ্রান্তভাবে খুঁটে খুঁটে তুলে আনে গভীর ব্যঞ্জনাময় অগণিত মায়াবি লোকমোটিফ।

মূলত এক দিওয়ানা কবির ভালোবাসার আখ্যান হলেও এ ছবির অর্ন্তলীন বক্তব্য বিদ্রোহেরও। সে বিদ্রোহ সামন্ত শাসক ও আচারসর্বস্ব গির্জার বিরুদ্ধে। কখনও অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে, কখনওবা সরাসরি সেই বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের আঁচ টের পাওয়া যায় সের্গেই পারাজানভের বর্ণিল ক্যানভাসে। তবে শেষবিচারে তিনি শান্তির প্রবক্তা। তাই দেখি ছবির শেষে রাজপ্রাসাদ থেকে একটি বন্দি পায়রা উড়ে চলে যায় খোলা দিগন্তের দিকে। একটি আচমকা কাট এর পর দেখা যায় সেই পায়রাটি এসে বসেছে সের্গেইর ক্যামেরার ওপর। ছবি শেষ হয়। পর্দায় ভেসে ওঠে, Dedicated To Andrey Tarkovosky আর এই একটি দৃশ্যেই আমরা বুঝতে পারি, সের্গেই পারাজানভ সত্যি অনন্য, মৌলিক প্রতিভায় উজ্জ্বল, আন্দ্রেই তারকোভস্কির এক সুযোগ্য উত্তরসূরিই বটে। তাঁকে নিঃশব্দ কুর্নিশ আমাদের।