জন্মশতবর্ষ

ওসমান সেমবেনে: দেখা ও শোনা

আলম খোরশেদ প্রকাশিত: নভেম্বর ১৭, ২০২৩, ০৪:২৫ পিএম ওসমান সেমবেনে: দেখা ও শোনা

আশির দশকের গোড়ার দিকে ঢাকা অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে ফরাসি ভাষা শেখার সময় মান্ডাবি নামে সেনেগালের একটি ছবি দেখে মুগ্ধ, বিস্মিত হয়েছিলাম তার নান্দনিক ঐশ্বর্য ও বিষয় বৈভবে। সে ছবির নির্মাতা ছিলেন সেমবেনে ওসমান, আমরা যাকে ওসমান সেমবেনে বলেই জানি। এর কিছুকাল বাদেই চট্টগ্রাম ব্রিটিশ কাউন্সিলে বিলেতের জঙ্গি চলচ্চিত্রকর্মী জেমস লিহি পরিচালিত একটি আশ্চর্য কর্মশালায় অংশ নিতে গিয়ে সেমবেনে সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে পারি। সেমবেনের হাতেই আধুনিক আফ্রিকান চলচ্চিত্রের জন্ম জেনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা দ্বিগুণ হয় এবং সেই কর্মশালাতেই বরোম সেরেট নামে তাঁর দশ মিনিটের একখানা বিদ্যুৎপ্রভ ছবি দেখে রীতিমতো সেমবেনে-ভক্ত হয় পড়ি। ১৯৮৮ সালে নিউ ইয়র্কে এসে, মনে পড়ে, ডনেল লাইব্রেরির চলচ্চিত্র বিভাগে প্রথমেই বেছে বেছে সেমবেনের ছবিগুলো নিয়ে আট মিলিমিটারের প্রজেক্টরে বারবার চালিয়ে দেখেছি লাইব্রেরির ব্যক্তিগত প্রেক্ষণ-প্রকোষ্ঠে বসে। এভাবে একে একে তাঁর পরিচালিত ব্ল্যাক গার্ল, খালা (Xala) ইত্যাদি ছবিগুলো দেখে সন্দেহ থাকে না যে, ওসমান সেমবেনে যথার্থই একজন উঁচুদরের শিল্পী; যেমন সূক্ষ্ম তাঁর শিল্পবোধ তেমনি গভীর সামাজিক দায়বদ্ধতা। আফ্রিকার সমাজকে এমন মমতা আর মনীষা মিশিয়ে তিনি আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন যে, আমরা এই মহাদেশের গভীর ট্র্যাজেডিকে একেবারে নিজের করে অনুভব করেছি, যুক্ত হতে পেরেছি তাঁর দাসত্ব শৃঙ্খল ছেঁড়ার সংক্ষুব্ধ সংগ্রামে।

এহেন সেমবেনেরই সর্বশেষ ছবি গেলওয়ার (১৯৯২) দেখার এবং তার চেয়েও বড় কথা, খোদ তার রূপকার বিশ্ববিশ্রুত ওসমান সেমবেনেকে চাক্ষুস দেখা ও শোনার অমূল্য অভিজ্ঞতা হল সেই একই বছর নিউ ইয়র্ক নগরেই। বিখ্যাত গ্রিনিচ ভিলেজের কেন্দ্রে অবস্থিত নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজন করেছিল Black Cinema: a Celebration of Pan African Film নামে একটি চমৎকার চলচ্চিত্র উৎসবের। তাতেই দেখান হল সেমবেনের এই ছবিখানা এবং তারই সমাপ্তি দিবসে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বযং তিনি। বস্তুত ওসমান সেমবেনের মনোমুগ্ধকর বক্তৃতা দিয়েই শেষ হয়েছিল এই অনিন্দ্য উৎসবের। তো সেই ছবি দেখা ও তাঁর বক্তৃতা শোনার আশ্চর্য অভিজ্ঞতাকে বঙ্গভাষী পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেয়াই এই রচনার আদত উদ্দেশ্য। প্রথমে আসা যাক তাঁর ছবির প্রসঙ্গে।

গেলওয়ার সেই সময়কার সেনেগালেরই একটি তীক্ষ্ণ আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক ভাষ্য। মূল চরিত্রের নামেই ছবির নাম। সেনেগালের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মুখপাত্র গেলওয়ার আদ্যোপান্ত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর মূল জেহাদ অবশ্য স্বসম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত নয়, সেনেগালের ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতার বিরুদ্ধে। ফলত স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে রাষ্ট্রযন্ত্র ও শাসকশ্রেণির কোপদৃষ্টিতে পড়তে হয়। কেননা আর সব অনুন্নত রাষ্ট্রের মতো সেনেগালের শাসকশ্রেণির দুর্নীতির একটি প্রধান নির্ভর এই বিদেশি সাহায্য। একদিন রাষ্ট্রযন্ত্রের ভাড়াটে গুন্ডার হাতে তাঁকে তাই খুন হতে হয়। তাঁর লাশ গুম করতে গিয়ে তাড়াহুড়ায় ভুল করে তাঁকে একটি মুসলিম কবরস্থানে সমাহিত করে দিলে এবং পরে তা জানাজানি হয়ে গেলে দুই সম্প্রদায়ের ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর মধ্যে শুরু হয় তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা।

এভাবে একটি চরিত্রের জীবনালেখ্য রচনা করার সূত্রে সেমবেনে বর্তমান সেনেগালের জ্বলন্ত কিছু সামাজিক সমস্যা ও প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসেন এবং বলাবাহুল্য অত্যন্ত শিল্পসম্মতভাবে গভীর মানবিক বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যমে তীব্র সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। কখনও কখনও মনে হয়েছে ছবিটি বুঝি কোনো আত্মমর্যাদাবান নিপুণ অর্থনীতিবিদের তৈরী, এমনই স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন ছিল তাঁর আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণসমূহ। ছবির শেষ দৃশ্যটি মনে রাখার মতো। অনেক বাদবিসম্বাদের পর খ্রিস্টান সম্প্রদায় তাদের নেতা গেলওয়ারের লাশ মুসলিম কবরখানা থেকে তুলে আনতে সক্ষম হয়। তাঁর কফিন নিয়ে ফেরার পথে অপরদিক থেকে আসা বিদেশি সাহায্য সংস্থার খাদ্যবাহী একটি গাড়ির মুখোমুখি হয় তারা। এমন সময় গেলওয়ারের আদর্শে উজ্জীবিত একদল বিক্ষুব্ধ তরুণ সেই গাড়ি থেকে শস্যসামগ্রী কেড়ে নিয়ে পথে পথে ছড়িয়ে দেয় আর গেলওয়ারের শববাহী গাড়ি সেই রাঙা মাটির পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শাদা শস্য মাড়িয়ে যেতে যেতে একসময় স্থির হয়ে যায়। অপূর্ব প্রতীকী ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ এই দৃশ্যটিতে সেমবেনে চলচ্চিত্রভাষার একজন নিপুণ শিল্পীরূপে নিজেকে নিঃসংশয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।

এবার খোদ সেমবেনে প্রসঙ্গ। উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে কানায় কানায় হলভর্তি শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ দর্শকের সামনে চমৎকার চিত্রবিচিত্র আফ্রিকার নিজস্ব পোশাকপরা সেমবেনে মঞ্চে এসে সবাইকে সহাস্য অভিবাদন জানান। সে বছর তিনি সত্তরে পা দিয়েছেন, অথচ কী বলিষ্ঠ, প্রায় সজীব এক তরুণের ন্যায় কথা বলতে শুরু করলেন ফরাসিতে, এক দোভাষী সঙ্গে সঙ্গে তা ইংরেজিতে তর্জমা করে দিচ্ছিল। কোনো গুরুগম্ভীর কথা নয়, গল্পচ্ছলে তাঁর নিজের জীবনের কাহিনি দিয়ে শুরু করলেন। জেলের ছেলে সেমবেনে কী করে মাছ ধরা থেকে গাড়িচালকের পেশা পেরিয়ে একপর্যায়ে আফ্রিকার একজন শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার হয়ে উঠলেন, সেই সংগ্রামমুখর জীবনের অনুপ্রেরণাময় কাহিনি। বহুবিচিত্র জীবনের অজস্র অভিজ্ঞতার অভিঘাতে জন্ম নেয় যে খাঁটি জীবনবীক্ষা ও মনীষা, তা-ই যেন ফুটে বেরুচ্ছিল তাঁর বচনে, ভঙ্গিতে। তিনি এমনকি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করলেন তাঁর চোখে পৃথিবীর কেন্দ্র আফ্রিকাই, ইউরোপ নয়। তাঁর মতে ইউরোপ কিংবা আরব কোনোটাই সেনেগালের আদর্শ হতে পারে না। আফ্রিকা তার নিজস্ব ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের চলার পথ নির্মাণ করে নিতে পারবে। কালোদের ওপর বর্ণগর্বী শ্বেতাঙ্গদের ঐতিহাসিক অত্যাচার, যা আজও সূক্ষ্ম ও স্থূল নানাভাবে বর্তমান, তার তীব্র নিন্দা করেন তিনি এবং দর্শকের সারিতে বসে থাকা তাঁর পুত্রের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন, সে যদি তার পূর্বপুরুষের মতো শাদাদের দেখে টুপি খুলে মাথা নত করে তবে তিনি তাকে খুন করবেন।

প্রায় একঘণ্টা ধরে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ রাখেন সেমবেনে তাঁর তীব্র আবেগপূর্ণ বক্তৃতায়। শেষে সেমবেনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রথমবারের মতো প্রদর্শিত হয় তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত তাঁরই স্বমহাদেশীয়, সেই নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনারত, কেনিয়ার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও সংগ্রামী লেখক নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো পরিচালিত একটি অনবদ্য প্রামাণ্যচিত্র। সেটি ছিল অনুষ্ঠানের আরেক বাড়তি আকর্ষণ।