রুশ চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ ত্রয়কা

আলম খোরশেদ প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২৩, ০৬:৩৬ পিএম রুশ চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ ত্রয়কা
কুলেশভ, পুদভকিন, এইজেনস্টেইন

বিশ্ব-চলচ্চিত্রের ইতিহাসবিষয়ে অবহিতজনেরা জানেন, শৈল্পিক ও আধুনিক চলচ্চিত্রের সূত্রপাত প্রধানত রুশদেশ তথা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। আর এর প্রধান পথিকৃৎ হিসেবে প্রথমেই যাঁর নাম মনে আসে সবার, তিনি আর কেউ নন সের্গেই এইজেনস্টেইন বা প্রচলিত উচ্চারণে আইজেনস্টাইন (১৮৯৮-১৯৪৮)। কিন্তু আমি সত্যিকার পথিকৃতের স্বীকৃতিটুকু আসলে দিতে চাই তাঁর চেয়ে এক বছরের ছোট আরেক চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিন্তক লেভ কুলেশভকে (১৮৯৯-১৯৭০)। 


এইজেনস্টেইনের নামের সঙ্গে যেমন মন্তাজ বিষয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, তেমনি কুলেশভের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কুলেশভ এফেক্ট নামে সম্পাদনার একটি বিশেষ রীতি। এইজেনস্টেইনের মতো কুলেশভেরও রয়েছে চলচ্চিত্রলেখক হিসেবে খ্যাতি, The Basics of Film Direction নামে একটি অত্যন্ত মূল্যবান ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রবিষয়ক গ্রন্থ যার সাক্ষ্য বহন করে। তবে কুলেশভ মূলত চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র শিক্ষাকেন্দ্র মস্কো ফিল্ম ইনস্টিটিউট এর অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে। তিনি ছিলেন সেই ইনস্টিটিউটের এবং সেই অর্থে সমগ্র পৃথিবীর সর্বপ্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক ক্লাসের পরিচালক ও শিক্ষক। অনেকেই হয়তো এটা জেনে চমকে উঠবেন যে, খোদ এইজেনস্টেইন সেখানে কিছুদিনের জন্য তাঁর ছাত্র ছিলেন। চলচ্চিত্রকার হিসেবে লেভ কুলেশভের হাতেখড়ি হয় একেবারে তরুণ বয়সেই,যৌথভাবে Twilight (১৯১৭) ছবিটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। তাঁর মাস্টারপিস কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম The Extraordinary Adventures of Mr. West in the Land of the Bolsheviks (১৯২৪), যা মূলত একটি হাস্যরসাত্মক অ্যাকশনধর্মী। তাঁর পরের ছবি By the Law (১৯২৬)জ্যাক লন্ডনের ছোটগল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি মনস্তাত্ত্বিক ঘরানার ছবি। তাঁর অপর গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র The Great Consoler (১৯৩৩)তিনি নির্মাণ করেছিলেন আরেক প্রখ্যাত মার্কিন কথাসাহিত্যিক ও’হেনরির জীবন ও কর্মের ওপর ভিত্তি করে। ১৯৪৩ সালে তিনি অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্রকার স্ত্রী আলেক্সান্দ্রা খোখলোভার (১৮৯৭-১৯৮৫)সঙ্গে মিলে তাঁর জীবনের সর্বশেষ ছবি We from the Urals নির্মাণ করেন। এর পর থেকে আমৃত্যু তিনি মস্কো ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শৈল্পিক পরিচালক ও শিক্ষক হিসেবেই কর্মরত ছিলেন।


কুলেশভের সঙ্গে যেহেতু এইজেনস্টেইনের একটা তুলনা এসেই গেছে সেহেতু এক্ষণে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যেতে পারে। সের্গেই এইজেনস্টেইনের নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই একটি নির্বাক চলচ্চিত্র, Battleship Potemkin (১৯২৫) এর কথা আমাদের সবার মনে পড়ে যায়, যাকে বিশ্বের সর্বত্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একটি চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে অদ্যাবধি। আধুনিক চলচ্চিত্রের এক বিশেষ ভাষারীতি সোভিয়েত মন্তাজ এর জনক সের্গেই এইজেনস্টেইন শুরুতে থিয়েটারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকলেও একপর্যায়ে চলচ্চিত্রই হয়ে ওঠে তাঁর ধ্যানজ্ঞান। ১৯২৩ সালে Glumov's Diary নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্রকার হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। যদিও এর মাত্র দুবছরের মাথায় ১৯২৫ সালে তিনি Strike নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন, যা ছিল রুশ বিপ্লবের ওপর তাঁর নির্মিতব্য ট্রিলজির প্রথম খণ্ড। এরই দ্বিতীয় পর্ব পূর্বোল্লিখিত ব্যাটলশিপ পটেমকিন ছবিটি। রুশ বিপ্লবের দশকপূর্তি উপলক্ষ্যে ট্রিলজির সর্বশেষ ছবি October: Ten Days That Shook the World  (১৯২৭) নির্মাণ করেন তিনি। তাঁর অপর দুই উল্লেখযোগ্য কাজ Alexander Nevsky (১৯৩৮) ও Ivan the Terrible (১৯৪৪, ১৯৫৮)। ইভান দা টেরিবল ছবিটিকেও তিনি একটি ট্রিলজি আকারেই নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রথম খণ্ডটি মুক্তির পর সোভিয়েত শাসকদের সঙ্গে তাঁর আদর্শিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হলে ছবিটির দ্বিতীয় পর্ব তাঁর জীবদ্দশায় আলোর মুখ দেখতে পায়নি, যদিও ১৯৪৬ সালেই তিনি এর কাজ সমাপ্ত করে ট্রিলজির শেষ পর্বের কাজেও হাত দিয়েছিলেন। আগেই বলেছি, তিনি ছিলেন চলচ্চিত্রভাষার একজন অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক, চিন্তক ও লেখক, যার অন্যতম নিদর্শন ফিল্ম ফর্ম ও ফিল্ম সেন্স নামক কালজয়ী গ্রন্থদুটি। ১৯৪৮ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর অকাল প্রয়াণ ঘটে।


আলোচ্য তিন পথিকৃতের মধ্যে যিনি সর্বাগ্রজ সেই ভ্সেভলদ পুদভকিনের জন্ম ১৮৯৩ সালে। তাঁর নামের সঙ্গে অমর হয়ে আছে নির্বাক যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি মাদার, যেটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন এইজেনস্টেইনের বিখ্যাত ব্যাটলশিপ পটেমকিন মুক্তি পাওয়ার পরের বছরই, ১৯২৬ সালে। সবারই জানা, এটি বিশ্ববিশ্রুত সোভিয়েত লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির একই নামের ততোধিক বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। এইজেনস্টেইনের মতো পুদভকিনও কিছুদিনের জন্য লেভ কুলেশভের ছাত্র ছিলেন। তিনিও মন্তাজ বিষয়ে প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন এবং আধুনিক চলচ্চিত্রের ভাষা ও ব্যাকরণ নির্মাণেও তাঁর বিশাল অবদান রয়েছে। চলচ্চিত্র বিষয়ে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি তাঁর এইসব তত্ত্ব ও ভাবনাসমূহ লিপিবদ্ধ করে গেছেন, যা তাঁর বিখ্যাত Film Technique and Film Acting গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে পরবর্তীকালে। সোভিয়েত চলচ্চিত্রে শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিনি, সতীর্থ সের্গেই এইজেনস্টেইন ও তাঁর বন্ধু গ্রিগরি আলেক্সান্দ্রভের সঙ্গে মিলেই আসলে রুশ চলচ্চিত্রের Manifesto of Sound রচনা করেছিলেন। তাঁর এই শব্দ নিয়ে চিন্তাভাবনার সফল বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় A Simple Case (১৯৩২) ও The Deserter (১৯৩৩)নামক ছবিদুটোতে।

পুদভকিনের অপর দুই আলোচিত চলচ্চিত্র The End of St. Petersburg (১৯২৭) ও Storm Over Asia (১৯২৮), যা মূলত তাঁর রুশ বিপ্লব নিয়ে নির্মিত ট্রিলজিরই শেষ দুই পর্ব। প্রসঙ্গত পুদভকিনের জীবন ও কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দুজনে মানুষের নাম না করলেই নয়। তাঁদের একজন তাঁর স্ত্রী Anna Zemtsova (১৮৯৩-১৯৬৫), যিনি নিজে একজন দক্ষ অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক ছিলেন, এবং যাঁর প্রতি অসীম ঋণের কথা পুদভকিন নিজেই স্বীকার করে গেছেন। অপরজন Mikhail Doller (১৮৮৯-১৯৫২), যিনি পুদভকিনের ছায়াসঙ্গী হয়ে সহপরিচালক হিসেবে তাঁর বেশকিছু ছবিতে কাজ করেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, এইজেনস্টেইনের মতো পুদভকিনও তেমন দীর্ঘায়ু হননি। ১৯৫৩ সালে তাঁর সর্বশেষ ছবি The Return of Vasili Bortnikov নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রয়াত হন। মস্কোতে তাঁর স্মৃতিতে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে।  

সোভিয়েত চলচ্চিত্রের এই স্বপ্নবান পথিকৃৎ ত্রয়কার মেধায় ও শ্রমে নির্মিত পথেই পরবর্তীকালে ক্যামেরাকাঁধে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে এসেছেন সের্গেই বন্দারচুক (১৯২০-১৯৯৪), সের্গেই পারাঝানভ (১৯২৪-১৯৯০), তেনগিজ আবুলাদজে (১৯২৪-১৯৯৪), আন্দ্রে তারকোভোস্কি (১৯৩২-১৯৮৬), কিরা মুরাতভা (১৯৩৪-২০১৮), লারিসা শেপিটকোর (১৯৩৮-১৯৭৯) মতো উজ্জ্বল উত্তরসূরিরা। এবং এখনও সেই পথেই সগৌরবে হেঁটে চলেছেন আন্দ্রে কনচালোভস্কি (জন্ম ১৯৩৭), নিকিতা মিখালকভ (জন্ম ১৯৪৫), পাভেল লুঙ্গিন (জন্ম ১৯৪৯), আলেক্সান্ডার শকুরভ (জন্ম ১৯৫১), আন্দ্রে ক্রাভ্চুক (জন্ম ১৯৬২), আন্দ্রে ঝভিগিয়ানৎসেভ (জন্ম ১৯৬৪) এর মতো বিশ্বমাতানো তুখোড় চলচ্চিত্রনির্মাতারা।