শতবর্ষে মৃণাল

বিধান রিবেরু প্রকাশিত: মে ২৬, ২০২৩, ১১:১৭ এএম শতবর্ষে মৃণাল

যে মৃণাল ফুটেছিল একশ বছর আগে তার তরঙ্গ আজও সিনেমা সমুদ্রে ঢেউ তোলে, তরঙ্গায়িত করে সিনেমাপ্রেমীদের। আজকালকার মতো বক্সঅফিসের পেছনে ছোটা নয়, জনতুষ্টির তোয়াক্কা নয়, রাষ্ট্রক্ষমতাকে তোয়াজ নয়, এক দুর্দমনীয় সাহস, বিপন্ন বিস্ময়, আর মানুষের জন্য অদম্য মমতা লালন করে, শিল্পকে তিনি করে তুলেছিলেন নিজের প্রতর্ক হাজির করার মোক্ষম হাতিয়ার। যে সময়ে তিনি শিল্প সৃষ্টিতে ব্রতী হয়েছিলেন সেটি ছিল ভীষণ উত্তাল সময়। পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক, শুদ্ধ উপমহাদেশ নয়, গোটা দুনিয়া আগ্নেয়গিরির মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল, বিস্ফোরণে জানান দিচ্ছিল নতুন সময় সমাগত। সমকালের শিল্পীরাও সেই অদূর পরিবর্তনের স্বরধ্বনির সাথে কোরাসে মিলিয়েছিলেন নির্দ্বিধায়। মৃণাল সেন সেই সময়েরই শিল্পী। সেই সময়েরই এক বিস্ফোরণ্মুখ চলচ্চিত্র নির্মাতা। নতুন শতকেও তিনি সিনেমা বানিয়েছেন, তবে তা শুরুর তিন দশকের সঙ্গে তুলনীয় নয়।


ফরিদুপুরে ১৯২৩ সালের ১৪ মে জন্ম নেয়া মৃণালের কৈশোর কেটেছে বাংলাদেশে। এরপর তিনি পড়াশোনার জন্য কলকাতায় যান, জড়িয়ে পড়েন বামপন্থী রাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে। ‘রাতভোর’ (১৯৫৫), ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৯) এসব ছবিকে নিজের ফিল্মোগ্রাফি থেকে বাদ দিতে পারলে হাফ ছেড়ে বাঁচেন মৃণাল। কেন যেন দৃঢ় রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরটা সেসব ছবিতে অনুপস্থিত। তবে কিছুটা রাজনীতি ও কিছুটা সমাজনীতি নিয়ে মৃণাল হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয় তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) দিয়ে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুই পর্যায়েই আসে স্বীকৃতি। ‘পুনশ্চ’ (১৯৬১) বা ‘আকাশ কুসুমে’র (১৯৬৫) মতো ছবিগুলোতে সম্পর্কের আড়ালে নগরে টিকে থাকার সংগ্রাম, ব্যক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা, বড়লোক হওয়ার লোভ-লালসা ও তার পরিণতি বিধৃত হয়েছে। এরপর ‘ভুবন সোম’ (১৯৬৯) দিয়ে মৃণাল জায়গা করে নেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের নয়া জাগরণে। এক সরকারি এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার রূপান্তরের কাহিনি বলা হয় এখানে। সততার চরমপন্থা থেকে যিনি কিছুটা সরে এসে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয়া শিখে যান, গ্রাম থেকে ঘুরে এসে। এ যেন এক মেটামরফোসিস। 


এই ছবির পর মৃণাল আর রেখেঢেকে কথা বলতে নারাজ। তিনি যেন জঁ-লুক গদারকে অনুসরণ করছেন এই পর্বে। একে একে বানালেন কলকাতা ত্রয়ী। ‘ইন্টারভিউ’ (১৯৭০), ‘কলকাতা ৭১’ (১৯৭২) ও ‘পদাতিক’ (১৯৭৩) এই ত্রয়ীকে পূর্ণতা দিলো কোরাস (১৯৭৪)। এই চারটি ছবি দিয়ে সমসাময়িক ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা খুঁড়ে তিনি দেখানোর চেষ্টা করলেন ঔপনিবেশিক মানসিকতা, সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণদের বিপ্লব ও হতাশা এবং সমাজের উচ্চশ্রেণির লোকেদের ভণ্ডামি। এরপরের ছবিতে মৃণাল সেন যেন বিপ্লবকে পরখ করে দেখে নিতে চাইলেন অতীতে ঘটে যাওয়া সাঁওতাল বিদ্রোহ ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে। তিনি বানালেন ‘মৃগয়া’ (১৯৭৬)। এক সাঁওতাল শিকারি ও স্বদেশী আন্দোলনকারীর ভেতর দিয়ে স্মরণ করলেন সিধু ও কানুকে। অবশ্য চোরাস্রোতে তিনি নকশাল বাড়ি আন্দোলনে ফাঁসি হওয়া রাজনৈতিককর্মীদেরকেও প্রবাহিত করে দেন।


সমাজবিপ্লব ও বিদ্রোহের কালপর্বের পর মৃণাল চোখে ফেরান মধ্যবিত্তের দিকে। মধ্যবিত্তের মনোভঙ্গির দিকে। ‘একদিন প্রতিদিন’ (১৯৭৯) ছবিতে একটি মেয়ে পরিস্থিতির চাপে পড়ে সারারাত বাড়ি ফিরতে পারেনি। কিন্তু এনিয়ে মধ্যবিত্ত পরিবার ও প্রতিবেশী যেন মুখোশ খুলে নিজেদের চেহারা দেখাতে শুরু করে। ‘খারিজ’ (১৯৮২) ছবিতেও দেখা যায় মধ্যবিত্তের স্বার্থপরতার স্বরূপ। ‘খণ্ডহর’ (১৯৮৩) চলচ্চিত্রেও মধ্যবিত্ত আছে, তবে সেই সাথে আছে গ্রাম ও শহরের মানসিক দূরত্বের খতিয়ান। শহুরে মধ্যবিত্তরা শুধু স্বার্থপর নয়, পলায়নপর মনোবৃত্তিরও বটে, এই ছবি যেন নিস্তরঙ্গ করুণ বয়ানে সেটাই বলতে চায়। 


মৃণাল সেনের তৈরি করা ২৮টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের শেষের ছবিটির কথা যদি বলি—‘আমার ভুবন; (২০০২)—সেখানে মৃণাল সেন প্রেম, ঈর্ষা ও শ্রেণিভেদকে ছাপিয়ে মানবিক সম্পর্কের বয়ান রচনা করলেন। দেখালেন দুই ভাই ও এক নারীর গল্প। চাচাত সেই দুই ভাইয়ের একজন গরিব দিনমজুর, আরেকজন বিদেশফেরত ধনী ব্যবসায়ী। তাদের জগত আবর্তিত এক সাধারণ নারীকে ঘিরে। কিন্তু কোনো দ্বন্দ্ব সেখানে উপস্থিত হয় না। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসাই সেখানে মূখ্য।  


মৃণাল সেনের সমগ্র কাজকে মোটা দাগে তিনভাগে ভাগ করা যায়। সূচনাকালে তিনি নিজস্ব ভাষা খুঁজে নেয়ার প্রচেষ্টায় রত। দ্বিতীয়ভাগে তিনি বলবার মতো বক্তব্য খুঁজে পেলেন, সেই সাথে পেলেন চলচ্চৈত্রিক ভাষার নিয়তি। মৃণাল একের পর এক দ্রোহের মন্ত্র উচ্চারণ করলেন এই মধ্যভাগের ছবিগুলোতে। তারপরই তিনি ধীরে ধীরে মধ্যবিত্তের অন্দরমহল হয়ে প্রবেশ করেন ব্যক্তির অন্তরমহলে। সামাজিক সম্পর্কের ময়নাতদন্ত শেষ করে তিনি থিতু হন মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে।


মৃণাল সেন নিজেকে একাধারে মনে করতেন ব্যক্তিগত পর্যায়ের মার্ক্সবাদ চর্চাকারী, আবার তিনি ছিলেন আইজেনস্টানপন্থী ও ব্রেখটের ভক্ত। তাই সমগ্র কাজে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে এক অনন্য চৈতন্য সৃষ্টির প্রয়াসী তিনি। তিনি বিশ্বাস করতে দর্শক তার ইন্দ্রিয় দিয়ে দেখার পাশাপাশি বৌদ্ধিক দরজাও খোলা রাখবে, তাতেই চলচ্চিত্র-চেতনাকে নিজের চৈতন্য দিয়ে আবিষ্কার করা যাবে। চলচ্চিত্র দেখা আর কবিতা পড়ার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। মগজ ও হৃদয়ের সমন্বয়ে দৃশ্য-সংলাপের স্তর পেরিয়ে দর্শক ‘ডায়ালেকটিসে’ প্রবেশ করবে, তাদের ভেতর চেতনার উন্মেষ ঘটবে সেটাই ছিলো মৃণালের প্রত্যাশা। 


তবে বর্তমানের মুক্তবাজার অর্থনীতির মোড়কে যেভাবে বড় পুঁজির ছবি অপেক্ষকৃত ছোট বাজারের উপরও হামলে পড়ছে, সেখানে মৃণালের কাঙ্ক্ষিত চৈতন্য নিয়ে খুব কম নির্মাতাই কাজ করেন। কারণ এখন বিশুদ্ধ শিল্প বলি, বা মানুষের জন্য শিল্প বলি, কোনোটাই নেই। কলাকৈবল্যবাদ যেমন বিদায় নিয়েছে, তেমনি অস্ত গেছে গণমানুষের জন্য শিল্পসৃষ্টির তাগিদ। তার জায়গায় এসেছে বাণিজ্যিক ও আধাবাণিজ্যিক ধারার ছবি নির্মাতারা। বুদ্ধি ও হৃদয় নিয়ে দর্শক যেন চলচ্চিত্রে ‘চৈতন্য’ আবিষ্কার করতে পারে সেরকম ছবির নির্মাতা এখন কোথায়? আসলে গত শতাব্দীর সে এক সময় ছিল, যখন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, জহির রায়হান, আলমগীর কবির, সুভাষ দত্তরা ছিলেন। তাঁরা জানতেন উজানে কেমন করে নৌকার বৈঠা ঠেলতে হয়। ইদানিং প্রায় সকলেই দেখি ভাটি গাঙের নাইয়া।